chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

বন্দর আবাসিকে নির্ধারিত মাত্রার তিন গুণ শব্দদূষণ!

নিজস্ব প্রতিবেদক : চট্টগ্রাম নগরীতে শব্দদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিনিয়ত যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন, নির্মাণ কাজ, কল-কারখানার উৎপাদন যন্ত্রের শব্দদূষণ প্রভৃতি বাড়িয়ে তুলছে এর সহনীয় মাত্র।

২০১৭ সালে পরিচালিত এক জরিপে শহরের ১০টি নির্বাচিত আবাসিক এলাকার মধ্যেনির্ধারিত মাত্রার প্রায় তিন গুণ শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় বন্দর আবাসিক এলাকায়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (চট্টগ্রাম গবেষণাগার) ফেরদৌস আনোয়ার চট্টলার খবরকে বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন মোড়ে নানা কারণে শব্দ দূষণ বাড়ছে। যানজট, হাইড্রোলিক হর্ন, কনস্ট্রাকশনের কাজ, কল-কারখানাসহ নানা কারণে এর মাত্রা বাড়ছে।

২০০৬ সালের শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা অনুযায়ী, কোথাও কোনো হাসপাতাল থাকলে সেটি ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত হবে। আর ‘নীরব এলাকায় চলাচলকালে যানবাহনে কোনো প্রকার হর্ন বাজানো যাবে না’।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে আইন ও বিধি রয়েছে, তা নিয়ে দু-এক বছর পরপর প্রচারণা চলে। কিন্তু কয়েক দিন চলার পর সব ঝিমিয়ে পড়ে। বিধি অনুযায়ী, নীরব এলাকায় হর্ন বাজালে প্রথমে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা। আবার নিয়ম ভাঙলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা জরিমানা করা হবে। কিন্তু এর প্রয়োগ হয় না বললেই চলে।

২০১৭ সালে পরিবেশ অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়নে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত এবং অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচির আওতায় আটটি বিভাগীয় শহরের শব্দের মাত্রা পরিমাপ বিষয়ক জরিপ করা হয়। জরিপ অনুযায়ী, শহরের ১০টি নির্বাচিত আবাসিক এলাকার মধ্যে ‘বন্দর আবাসিক এলাকার’ শব্দের মাত্রা নির্ধারিত মাত্রার প্রায় তিন গুণ পাওয়া যায়, যেখানে সর্বোচ্চ শব্দ মান ১৩০.৪ ডেসিবল এবং সর্বনিম্ন শব্দ মান ৫৭.৮ ডেসিবল, এক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ‘পোর্ট কলোনি মোড়’।

বন্দর আবাসিকে নির্ধারিত মাত্রার তিন গুণ শব্দদূষণ!
প্রতিনিয়ত যানবাহনের হর্ন শব্দদূষণের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। নগরীর দেওয়ানহাট মোড় থেকে তোলা। আলোকচিত্রী- এম ফয়সাল এলাহী

এ এলাকার শব্দের মানমাত্রা নির্ধারিত মাত্রার প্রায় ২ গুণ। ‘পোর্ট কলোনি মোড়’ এলাকার প্রাপ্ত শব্দের মানমাত্রা ৯৯.৩ ডেসিবল এবং সর্বনিম্ন শব্দ মাত্রা ৪৭.২ ডেসিবল। শহরের নির্বাচিত ১১টি মিশ্র এলাকার মধ্যে ‘ইপিজেড (ফ্রি পোর্ট মোড়)’ শব্দের মাত্রা নির্ধারিত মাত্রার প্রায় চারগুণ, যেখানে সর্বোচ্চ শব্দমান ১৩০.৬ ডেসিবল এবং ‘দক্ষিণ বাকলিয়া’ এলাকার সর্বনিম্ন শব্দ মান ৪৫.৮ ডেসিবল। নির্বাচিত ১১টি বাণিজ্যিক এলাকার এলাকার মধ্যে ‘পাহাড়তলী’ এলাকার শব্দের মাত্রা সর্বোচ্চ ১৩২.১ ডেসিবল।

এছাড়া ‘চাক্তাই’ এলাকার সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা ১৩০.৩ ডেসিবল এবং সর্বনিম্ন শব্দ মাত্রা ৫৫.৫ ডেসিবল। চট্টগ্রাম শহরের ৭টি নীরব এলাকা জামালখান রোড, সরকারি সিটি কলেজ, পাঠানটুলী, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতাল, ডায়াবেটিক হাসপাতাল, হামজারবাগ অন্যতম। এর মধ্যে ‘ডায়াবেটিক হাসপাতাল’ এলাকার শব্দের মাত্রা সর্বোচ্চ ১৩২.৪ ডেসিবল এবং সর্বনিম্ন শব্দ মাত্রা ৫৪.৮ ডেসিবল পাওয়া যায়। যেখানে নির্ধারিত মানমাত্রা মধ্যে নীরব এলাকার নির্ধারিত শব্দ মানমাত্রা সবচেয়ে কম। নীরব এলাকার অবস্থানরত মানুষের মধ্যে হাসপাতালের রোগী, গর্ভবতী মহিলা, স্কুলের শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা রয়েছে। যারা শব্দ দূষণের কারণে সাধারণ মানুষ থেকেও অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

এছাড়া চট্টগ্রাম শহরের নির্বাচিত ২টি শিল্প এলাকার মধ্যে ‘জালালাবাদ’ এলাকার শব্দের মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি। যেখানে সর্বোচ্চ শব্দ মান ১২৭.৮ ডেসিবল এবং সর্বনিম্ন মাত্রা ৫৪.৫ ডেসিবল। অন্যদিকে মনসুরাবাদ এলাকার শব্দ দূষণের পরিমাণও কম নয়। যেখানে সর্বোচ্চ শব্দ মান ১২৬.৬ ডেসিবল এবং সর্বনিম্ন মাত্রা ৫২.৭ ডেসিবল। এই শিল্প এলাকাগুলোর মানুষের শারীরিক ক্ষতির কারণ এই শব্দ দূষণ।

এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৫ সালে শব্দের একটা মানমাত্রা রেকর্ড করে তাতে দেখা যায় নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, শিল্প এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকাসহ সব জায়গায় সহনীয় মাত্রার চেয়ে শব্দ দূষণের মাত্রা প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি।

নগরীর জিইসি মোড় থেকে পাঁচলাইশ থানা পর্যন্ত ও.আর নিজাম সড়কের দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ দেড় কিলোমিটার। নগরীর ক্লিনিক পাড়া হিসেবে পরিচিত এই সড়কে ২০টির বেশি বেসরকারি ক্লিনিক ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাব রয়েছে। অনতিদূরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের অবস্থান। প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী ও চিকিৎসকের গাড়ি এই সড়ক দিয়ে চলাচল করে। এর ওপরে রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স। সাধারণ যানবাহনের পাশাপাশি এলাকার কয়েক লাখ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সের বিকট শব্দে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। এমনকি ফাঁকা রাস্তা বা ভোররাতেও অ্যাম্বুলেন্সগুলো সাইরেন না বাজিয়ে চলতে পারে না।

শুধু ও.আর নিজাম রোড নয়, পুরো চট্টগ্রাম শহরের বাসিন্দারাই আজ ভয়াবহ শব্দদূষণের শিকার। যানবাহনে উচ্চ মাত্রার হর্ন, হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার, অ্যাম্বুলেন্সের বিকট সাইরেন, নির্মাণ কাজের শব্দ, ইট ভাঙার মেশিনের শব্দ ছাড়াও সামাজিক অনুষ্ঠানসহ নানা ধরনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে অতি উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহারের কারণে শব্দদূষণ হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে হাইড্রোলিক হর্নের উৎপাত। মাঝরাতে বিভিন্ন আন্তঃজেলা বাস তীব্র শব্দে হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন আবাসিক এলাকার মধ্য দিয়ে যাতায়াত করে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে শব্দদূষণের মাত্রা ৮০ ডেসিবল থেকে ১১০ ডেসিবেল। কোনো কোনো স্থানে আরো বেশি। এই মাত্রা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। শব্দদূষণ এখন শব্দ সন্ত্রাসে পরিণত হয়েছে। নগরবাসীকে এই সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা করার কেউ যেনো নেই।

বিআরটিএ এর তথ্য মতে নগরীতে এক লাখের বেশি যানবাহন চলাচল করছে। যার ২০ শতাংশই ব্যবহার করছে হাইড্রোলকি হর্ন।

চিকিৎসকরা বলছেন, অতিমাত্রায় হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার আর বিকট শব্দের কারণে মাথাব্যথা ও শ্রবণশক্তি লোপসহ বাড়ছে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি।

‘স্বাস্থ্যে শব্দের প্রভাব’ শীর্ষক ওই প্রবন্ধে বলা হয়, আচমকা শব্দে (ইমপালস সাউন্ড) ও দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ শব্দের (৭৫ থেকে ৮৫ ডেসিবেল) মধ্যে থাকলে মানুষ শ্রবণক্ষমতা হারাতে পারে। কারণ, এতে কানের কোষ (সেল) মারা যায়। কানের কোষ মারা গেলে তা মনোযোগের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এই কোষ নতুন করে আর তৈরি হয় না।

এ সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বিশিষ্ট চিকিৎসক বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, অনিয়ন্ত্রিত যানচলাচলের কারণে চট্টগ্রামে শব্দ দূষণ বাড়ছে। এত মানুষ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় শিশুদের। তাদের বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গর্ভবতী নারীদের মৃত সন্তান জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। এছাড়া ভয়াবহ শব্দ সৃষ্টির ফলে মানুষের শ্রবণশক্তি কমে যাচ্ছে, হৃদরোগীর সংখ্যা বাড়ছে, পুরাতন হৃদরোগীর অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে, মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, হজম ক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে, মাংসপেশিতে খিঁচুনি হচ্ছে, মানুষের কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, পরিকল্পিত যানবাহন চলাচলের মাধ্যমে শব্দ দূষণ বন্ধ করা সম্ভব। সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। উন্নত দেশসমূহের সড়ক ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা উচিত।

চট্টগ্রামবাসী শব্দ সন্ত্রাস বন্ধে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনের পূর্ণ বাস্তবায়নসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে মোবাইল টিম গঠন করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া, রাতে আবাসিক এলাকায় নির্মাণকাজসহ শব্দ সৃষ্টিকারী যে কোনো ধরনের কাজ বন্ধ রাখা, গাড়িতে উচ্চমাত্রার হর্ন না থাকে তা নিশ্চিত করা, অপ্রয়োজনীয় হর্ন ব্যবহার না করা বিষয়ে চালকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতন করা, মাইকে পণ্য ও লটারি বিক্রি বন্ধ করা, জনসচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা বাড়ানো, সরকারি উদ্যোগ হর্নবিহীন দিবস পালনেরও দাবি জানান তারা।

এছাড়া সপ্তাহে একদিন নগরীতে জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন নগরবাসী।

এসএএস/এএমএস

এই বিভাগের আরও খবর