chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

‘কোনো মতে জীবনটা বাঁচাইছি’

রকিব কামাল: ধ্বংসস্তুপের মাঝে কী যেনো খুঁজছিলেন আনোয়ারা বেগম (৬৫)। একটু পরপর আধাপোড়া ছাইভস্ম থেকে বের করে আনছিলেন নাতনির পুড়ে যাওয়া কাপড়ের অংশ বিশেষ। সেদিকে নির্বাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। তখন তার চোখের কোণে ছলছল করছিল জল। কারণ অগ্নিকাণ্ডে তার বসতঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

পাশ থেকে আনোয়ারা বেগমের মেয়ে শাকি বেগম বলে উঠলেন, কিস্তি নিয়ে ঘর করেছিলাম। কিছু নেই, সব পুড়ে গেছে।
আনোয়ারা বেগমের এই কষ্টের দশা হবেই না কেনো? ত্রিশ বছর আগে স্বামীসহ দেবপাহাড়ের একটি বস্তিতে বসবাস শুরু করেন। গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপে। কয়েক বছর আগে মারা যান স্বামী। গৃহকর্মীর কাজ করে বহু কষ্টে দুই মেয়েকে বিয়ে দেন। ছোট ছেলেকে গার্মেন্টেসে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। সন্তানদের নিয়ে কোনো রকমে জীবন পার করছিল।

গতকাল শুক্রবার (১৫ অক্টোবর) বেলা ১১ টার দিকে দেবপাহাড়ের বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনের তীব্রতায় ১৬ টি ঘরের সঙ্গে পুড়ে যায় আনোয়ারা বেগমের ঘরটি। এক আগুনে তাদের যেন পথে বসিয়ে দিল।

কী খুঁজছিলেন এমন প্রশ্ন করতেই আনোয়ারা বেগমের চোখের জল গলিয়ে পড়ছিল। নিজে নিজে কথা বলছিলেন। প্রখর রোদের তাপে হাফিয়ে উঠছিলেন।

তিনি চট্টলার খবরকে বলেন, আগুন আগুন চিৎকারের শব্দে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসি। এসে দেখি আশেপাশের সব জায়গায় আগুন। মানুষ এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করতেছে। কিছুই বের করতে পারি নাই। কোনোমতে জীবনটা বাঁচাইছি।
কথা বলতেই বলতেই আবারও আধাপোড়া ছাইভস্ম কাজে শুরু করেন। তার কান্নার আওয়াজে আশেপাশের বেশ কয়েকজন মানুষের চোখ ভিজে যায়।

শনিবার (১৬ অক্টোবর) দুপুরে দেবপাহাড়ের গিয়ে দেখা গেছে বস্তির মুখে মানুষের জটলা। সবার মুখে শুধু গতকালের অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা। ঘটনাস্থলের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্রের ধ্বংসস্তুপ। আশেপাশের বাতাসে কান পাতালে ভেসে আসে সব হারানো মানুষের হাহাকার। সারা রাত খোলা আকাশে নিচে অনাহারে কাটাতে হয়েছে তাদের। আগুনে দগ্ধ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি আছেন নুর হোসেন ও শিল্পী নামে দুই বাসিন্দা।

এক পোশাকেই রিফা

নগরের সিজেকেএস স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী রিফা মনিকা কাজল (১১)। অগ্নিকাণ্ডে রিফার স্কুলের পোশাক, বই এবং দৈনন্দিন পরা পোশাক পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মায়ের সঙ্গে রিফাও স্কুলের বই ও পোশাক খুঁজছিল। গতকাল থেকে সে এক পোশাক গায়ে জড়িয়ে আছে। স্কুলের খাতা খুঁজে পেয়ে আনমনে এঁকে চলছিল মানুষের ছবি।

এক কাপড়ে রিফা খাতা পেয়ে আনমনে  করছে আঁকাআঁকি

রিফার মা শাকি বেগম গৃহকর্মীর কাজ করেন। বাবা কাজ করেন গার্মেন্টেসে। রিফা সবার বড়। তার ছোট বোনের বয়স সাত বছর। শাকি বেগম চট্টলার খবরকে বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তিন মাস আগে ঘর করেছিলাম। মাসে চার হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। ঘরের জন্য ২৫ কেজি চাল, ডাল, মসলাসহ চার হাজার টাকা বাজার করছি। মেয়েটার কাপড়, বই কোনোটাই বের করতে পারি নাই। খালি জানটা বাঁচাইছি। এখন ঘরের কাজ করাব নাকি কিস্তি পরিশোধ করব এই বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন শাকি।

মাটির চুলা থেকে অগ্নিকাণ্ড

সমতল ভূমি থেকে কয়েক ফিট উচুঁতে অবস্থিত দেবপাহাড়ের এই বস্তিটি। বস্তির সংকীর্ণ মুখ ধরে মুখোমুখি দুজন হাঁটাচলা করতে বেগ পেতে হয় মানুষকে। আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে ফায়ার সার্ভিসকে সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। এখানকার অধিকাংশ মহিলারা আশেপাশের বাসায় গৃহকর্মী ও পুরুষরা গার্মেন্টসে কাজ করেন। ঘটনার সময় বাসায় তেমন কেউ ছিল না। খবর পেয়ে তারা পরে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে।

বস্তির বেশ কয়েকজন মানুষ জানায়, আগুনে দগ্ধ নুর হোসেনের বাসায় মাটির চুলায় রান্না হচ্ছিল। রান্নার শেষে দিকে লাকড়ি থেকে টিনে আগুন লাগে। এর পাশে আরেকটি ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার থাকায় মুহূর্তের মধ্যে আগুন আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে তদন্ত করে আগুনের সূত্রপাত নিশ্চিত করা যাবে বলে জানানো হয়।

দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষের শেষ সম্বল, পাটকাঠির বেড়াঘর হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই হওয়া মানুষগুলোর চোখের জল হয়তো সহজে শুকাবে না।

আরকে/জেএইচ/চখ

এই বিভাগের আরও খবর