chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

শুঁটকিতে করোনার ধাক্কা, বিক্রি কমেছে ৫০ শতাংশ

রকিব কামাল: ভেতরে ঢুকতেই ঝাঁজালো গন্ধ এসে নাকে ঠেকল। একটু এগিয়ে যেতেই চোখ আটকে যায় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বাঁশের মাচায় কানায় কানায় পূর্ণ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। প্রখর রোদের মধ্যেই সে মাচায় রাখা মাছ রোদে শুকানোর কাজ সারছেন শ্রমিকরা।

কাজের ফাঁকে শুঁটকি নিয়ে আড্ডায় মেতেছেন শ্রমিকরা। রোদে শুকিয়ে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে পরিচর্যা করা এসব মাছ শুঁটকি হয়ে হাত বদলে পৌঁছে যায় গ্রাহকের কাছে।

নগরের বাকলিয়া বেড়িবাঁধ শুঁটকিপল্লী এলাকায় গিয়ে চোখে পড়ে শুঁটকি ঘিরে শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততা। জেলেদের জালে ধরা পড়া বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বাজার হয়ে এখানে আনা হয়। ৫০ খানি ভূমির শুঁটকিপট্টিতে হাজারের বেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।

তবে করোনার বিষাক্ত ছোবলে অনেকটা ধরাশায়ী হতে হয়েছে এই ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। পাইকারি ও আড়ত ব্যবসায়ীরা জানান, করোনায় গত বছরের চেয়ে চলতি বছরে ৫০ শতাংশ শুঁটকি বেচাবিক্রি কমেছে। এর ওপর বাজারে সক্রিয় সিন্ডিকেটের কারণে মধ্যম আয়ের ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। ক্রেতা না পেয়ে প্রতিষ্ঠানে নষ্ট হচ্ছে শুঁটকির গুণগত মান।

শুঁটকিতে করোনার ধাক্কা, বিক্রি কমেছ ৫০ শতাংশ
দেশের চাহিদা মিটিয়ে চট্টগ্রামের শুঁটকি যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। নগরীর বাকলিয়া বেড়িবাঁধ এ বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে শুঁটকি পল্লী। এতে হাজারো শ্রমিকরা কাজ করছে। আলোকচিত্রী এম ফয়সাল এলাহী

৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে শুঁটকি ব্যবসার সাথে যুক্ত আছেন মোদাচ্ছের আলী। সোনাদিয়া, মহেশখালী হয়ে ১৪ বছর আগে তিনি চট্টগ্রামে আসেন। মোদাচ্ছেরের কাছে জানতে চাওয়া হয় শুঁটকি ব্যবসার বর্তমান অবস্থা।

তিনি চট্টলার খবরকে বলেন, করোনার মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা কাজ করে গেছেন। ব্যবসায়ীরাও বাজার স্বাভাবিক রাখতে পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু আড়ত ব্যবসায়ীরা আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের টাকা আটকে রেখেছেন। অনেকে শুঁটকি নিয়ে ৬ মাস ঘুরিয়ে টাকা পরিশোধ করেছেন। ১০ লাখ টাকার মাল নিয়ে ঘুরিয়ে দিচ্ছে ৫ লাখ টাকা। অনেক সময় শ্রমিকদের বেতন দিতে সমস্যা হয়েছে।

বাজারে এর প্রভাব সম্পর্কে মোদাচ্ছের বলেন, টাকা পরিশোধ না করায় ব্যবসায়ীরা শুঁটকিপট্টি থেকে মাল ছাড়ছে না। আড়তে মাল সংকটের প্রভাবে পাইকারী থেকে খুচরা পর্যায়ে শুঁটকির দাম বাড়ছে। চাহিদার পরও বিভিন্ন স্থানে মাল পাওয়া যাচ্ছে না। এই সুযোগে বাজারে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা সুযোগ মতো মধ্যম ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাড়তি দাম নিচ্ছে। ঘুরে ফিরে ক্রেতাকে এর ভার বইতে হচ্ছে।

চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুখরোচক বাঙালির খাদ্য তালিকায় কদর বেড়েছে শুঁটকির। গৃহস্থালির পাশাপাশি বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ, সামাজিক অনুষ্ঠানে নানান পদের শুঁটকির চাহিদা সর্বাধিক। চট্টগ্রামে ঘরে ঘরে শুঁটকির চাহিদা আবহমান সময় থেকে। এখানে দেশের উৎপাদিত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ শুঁটকির চাহিদা রয়েছে।

নগরের আছাদগঞ্জে কক্সবাজার, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সুন্দরবনসহ বিভিন্ন স্থানের মাল আসে। এই মাল বিভিন্ন হাত হয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। স্থানীয় চাহিদা শেষে শুঁটকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, আবুধাবি, ওমানসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

আছাদগঞ্জে পাইকারীতে লইট্টা শুঁটকি কেজি প্রতি মানভেদে ৪০০ থেকে ৪৬০ টাকা, মইল্লা ৩৬০ থেকে ৩৭০ টাকা, টেংরা আকারভেদে ৫০০ থেকে ৫৩০ টাকা, ছুরি শুঁটকি আকারভেদে ২১০ থেকে ২৩০ এবং ৬০০ থেকে ৬২০ টাকা, বড় ছুরি ৮০০ টাকা, ছোট আকারের ইলিশ শুঁটকির প্রতি পিস ৩০ টাকা, মাঝারি আকারের ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা, বড় আকারের ইলিশ শুঁটকি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, ভালো মানের সুরমা মাছ ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকা, চিংড়ি ছুঁটকি ৮০০ টাকা, রুপচাঁদা শুঁটকি ২ হাজার থেকে ২৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে লইট্টা, ছুরির চাহিদা সর্বাধিক।

শুঁটকিতে করোনার ধাক্কা, বিক্রি কমেছ ৫০ শতাংশ
চট্টগ্রামে শুঁটকি শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে শ্রমিকরা। নগরীর বাকলিয়া বেড়িবাঁধ এলাকার শুঁটকি পল্লী থেকে তোলা ছবি। আলোকচিত্রী এম ফয়সাল এলাহী

আনিকা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. শাহাদাত চট্টলার খবরকে বলেন, লকডাউনে পাইকারী দোকানগুলো কার্যত অচল ছিল। খুচরা ব্যবসায়ীরা কিছুটা সুযোগ পেলেও কড়াকড়িতে পাইকারীতে ব্যবসা বন্ধ ছিল। সাগরে ৬৫ দিনে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় জেলেরা মাছ ধরতে পারেনি। তখন কোনো মাছ বাজারে আসেনি। গত বছরের চেয়ে অর্ধেক শতাংশের নিচে ব্যবসা বিক্রি কমেছে। যার ১০০০ টাকার মাল প্রয়োজন সে ৫০০ টাকা নিচ্ছে, যার ৫০০ টাকার প্রয়োজন সে ২০০ টাকার মাল নিচ্ছে। দোকানে দীর্ঘদিন মাল পড়ে থাকায় এর গুণগত মাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সে মাল আর বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার পাইকারী ব্যবসায়ীরা আছাদগঞ্জে আড়তে আসেন সদাই করতে। পুরো সপ্তাহের বিক্রি পুষে নিতে ব্যবসায়ীরা এ দুদিনের অপেক্ষায় থাকেন। মেসার্স সিরাজ ট্রেডিং এর স্বত্বাধিকারী মুহাম্মদ রুবেলের আড়ত ছাড়াও রয়েছে শুঁটকির খুচরা ও পাইকারী ব্যবসা। লকডাউনের পরও খুচরা দোকানে বিক্রি বাড়েনি বলে জানান তিনি।

রুবেল চট্টলার খবরকে বলেন, লকডাউনের দেড় মাস আগেও খুচরা দোকানে প্রতিদিন ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার শুঁটকি বিক্রি হতো। এখন ৫ হাজার টাকার বিক্রি করতে কষ্ট হচ্ছে। মানুষের আয় কমে যাওয়ায় তারা শুঁটকি কিনতে চাইছে না। এভাবে চললে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়াটা কষ্টকর হবে।

আরকে/এমআই

এই বিভাগের আরও খবর