একদিনে একই পরিবারের চারজনের জন্য কফিন বানাতে হয়েছে
ফার্ণিচার নয়, কাঠের দোকানে বিক্রি বেড়েছে কফিনের
ইফতেখার নিলয় : মোহাম্মদ জমির বেগ। গত ১০-১২ বছর ধরে নগরীর ২৩ নং উত্তর পাঠানটুলী ওয়ার্ডের বংশাল পাড়া রোডে কাঠের ফার্ণিচার তৈরির ব্যবসা করছেন। ব্যবসার প্রথম থেকেই ফার্ণিচার তৈরির পাশাপাশি ফরমায়েশের ভিত্তিতে কালেভদ্রে হাত দিতেন কফিন তৈরির কাজে। তবে, করোনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ফার্ণিচারের পরিবর্তে বানিয়ে বিক্রি করছেন লাশের কফিন।
চলতি বছরের কোরবানির ঈদের পর থেকেই বিরতীহীনভাবে আসতে শুরু করেছে কফিনের ফরমায়েশ। ফার্ণিচারের ব্যবসা নিয়ে সারাবছর বাড়তি ব্যস্ততা থাকলেও এখন কফিন তৈরিতেই শ্রমিকদের ব্যয় করতে হচ্ছে অধিক সময় । আগে যেখানে প্রতিদিন চেয়ার-টেবিল, খাট, আলমারি তৈরির কাজ বেশি পড়তো, এখন সেখানেই বেড়েছে কফিন তৈরির কাজ।
স্থায়ী ফার্ণিচার ব্যবসায়ে কালেভদ্রে আসা কফিনের ফরমায়েশ এখন হরহামেশাই আসছে। জানতে চাইলে জমির বেগ চট্টলার খবরকে বলেন, কোরবানির ঈদের পর যতো কফিন বিক্রি করলাম, আমি গত ১০-১২ বছরে এতোগুলো বিক্রি করতে পারিনি। এখন ফার্ণিচারের অর্ডার না, আসে শুধু কফিনের ফরমায়েশ।
একেকটি মজবুত কফিন তৈরিতে সময় ব্যয় হয় প্রায় তিন ঘন্টা। কফিন তৈরির শ্রমিক বৃদ্ধ আনসারী বলেন, অনেক পরিচিত মানুষের জন্যেও কফিন তৈরি করতে হয়েছে। পরিচিত মানুষের কফিন বানানোর সময় খুব খারাপ লাগে।
ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকলেও, ফার্ণিচারের বদলে নিয়মিত কফিন তৈরি করে ব্যবসার আয় চালু রাখতে হবে- এমনটা কখনোই ভাবেননি জমির বেগ। বহু পরিচিত মানুষের জন্যেও বানাতে হয়েছে কফিন, এগুলো নিয়মিতই পোড়ায় তাকে।
জমির বলেন, আমি চাই ফার্ণিচারের ফরমায়েশ আসুক। কফিন যারা বানাতে দেয়, তাদের চেহারার দিকে তাকালে আমার খুব কষ্ট হয়। প্রিয় মানুষের মৃত্যুতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে কফিনের ফরমায়েশ নিয়ে উপস্থিত হয় তারা। এমনকি একদিনে একই পরিবারের চারজনের জন্যেও কফিন বানাতে হয়েছে। এরমধ্যে দুইজন করোনায় আর দুইজন শোক সইতে না পেরে স্ট্রোকে মারা গেছে। বেশিরভাগ কফিন এখন করোনায় যারা মারা যাওয়াদের জন্যে বানাতে হয়।
তিনি আরো বলেন, যদিও যারা কল করে কফিনের কথা বলে, তারা করোনায় মৃত্যু হলে তা লুকাতে চায়। যেকোনো রোগে মৃত ব্যক্তির জন্যেই কফিন বানাতে কোনো সংকোচ নেই আমাদের।
হাজীপাড়া, মোগলটুলি, বাংলাবাজার, ফকিরহাট, দেওয়ানহাট, মিস্ত্রী পাড়াসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিনই এখন কফিন বানানোর অর্ডার আসে। সেই কফিনগুলো ভ্যানে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গন্তব্যে। বছর দুয়েক আগে চট্টগ্রামে কর্মরত এক চীনা শ্রমিকের মৃত্যু হলে জমিরের কাছেই কফিন বানাতে ছুটে আসে তার সহকর্মীরা। জমিরের কাঠের দোকানে বানানো কফিনে ভরে সেই শ্রমিকের লাশ নেয়া হয়েছিল চীনে।
আরও বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাইলে আবেগ ছুঁয়ে যায় জমিরকে। তিনি বলেন, প্রিয়জনের মৃত্যুতে গভীর রাতেও অনেকে কল করে কফিন বানিয়ে দেওয়ার কথা বলে। করোনার কারণে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। অনেকজনের লাশের কফিন বানিয়ে দিয়েছি। আমি চাইনা কেউ এভাবে দুনিয়া থেকে বিদায় নিক। পরিচিত অনেক আপন মানুষের জন্য কফিন বানিয়েছি, এটা খুবই কষ্টদায়ক।
বংশাল পাড়া রোডের বাসিন্দা মোহাম্মদ শফি এগিয়ে এসে বলেন, ‘রাস্তার উপর এখন প্রতিদিন কফিন বানানো হয়। আল্লাহ আমাদের দ্রুত মুক্তি দিক এসব থেকে। এতো মানুষের লাশের দাফনের যন্ত্রণা আর নিতে পারিনা।
ফার্ণিচার দোকানে ভাটা পড়েছে চেয়ার-টেবিল, খাট, ও আলমারি তৈরির স্বাভাবিক ব্যস্ততায়। করোনা মহামারির এই দু:সময়ে মৃত মানুষের জন্য কফিন তৈরির ব্যস্ততা বাড়লেও, সংশ্লিষ্টরা প্রত্যাশা করছেন দু:সময় কাটিয়ে ফার্ণিচার ব্যবসা চাঙা হবে ফের।
ইনি/এনএনআর