chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

মানসিক অস্থিরতায় বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা

রকিব কামাল : চঞ্চল ও দুরন্ত স্বভাবের কিশোরী ইয়াছিন আক্তার মুক্তা (১৪)। ছিলেন নগরের দৌলতপুর বহুমুখী উচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত ১৬ জুলাই হঠাৎ করেই গলায় ফাঁস দিয়ে বসেন মুক্তা।

হাসপাতালে নেওয়ার পর সে মারা যায়। পারিবারিক সমস্যার জেরে অভিমান করে মুক্তা আত্মহত্যা করেছে বলে জানায় পুলিশ।

সর্বশেষ গত ১১ জুলাই নগরের অক্সিজেন কাঁচা বাজার এলাকায় বিষণ্ণতা থেকে শ্বশুরবাড়িতে ওড়না প্যাচিয়ে আত্মহত্যা করে শায়লা শারমিন (২৯) নামের নামে গৃহবধূ।

এছাড়া গত ২০ জুলাই মধ্যম হালিশহর এলাকায় মো. মোস্তাফিজুর রহমান (৪৫) নামে এক টমটম চালক আত্মহত্যা করেন। মুক্তা, শায়লা কিংবা মোস্তাফিজুরের মতো অনেকে ‘আত্মহত্যা’ নামক শব্দে গণমাধ্যমের শিরোনামে যোগ হয়েছেন। গত কয়েক মাস ধরে সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রামে আত্মহত্যার প্রবণতা ভয়াবহ আকারে বেড়েছে। এ তালিকায় উঠতি বয়সী তরুণ থেকে চাকরি প্রত্যার্শীর সংখ্যা সর্বাধিক। রয়েছে গৃহবধূ থেকে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। দফায় দফায় লকডাউনের অভিঘাতে সংকুচিত হয়ে পড়েছে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের আয়ের উৎস।

মহামারির মুখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বন্ধ রয়েছে চাকরির পরীক্ষা। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দোলাচলে নিমর্জ্জিত শিক্ষার্থীরা। আয় কমে আসায় পরিবারের একমাত্র কর্তাকে চাল-ডালের হিসাব মেলাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিরুপায় হয়ে মধ্যবিত্তকে কষাতে হচ্ছে সঞ্চয়, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের আর্তনাদে ভারি হচ্ছে পরিবেশ। শিক্ষার্থী ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে কাজ করছেন আঁচল ফাউন্ডেশন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন অনলাইনে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে আসছে।

সর্বশেষ সংগঠনটি জানুয়ারিতে ২ হাজার ২৬ জনের ওপর জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে ১৮ থেকে ২৫, ২৬ থেকে ৩০ ও ৩১ থেকে ৩৫ বছরের বছর বয়সীরা অংশ নেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দারিদ্র্যতা, পারিবারিক টানাপড়েন, মনমালিন্য, অবসাদ, বিষণ্ণতা, মানসিক অস্থিরতা, অভিমান, সামাজিক অসঙ্গতির কারণে জীবন শেষ করে দেওযার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে মানুষ। টুনকো কারণেই নীরবে বিস্তার লাভ করছে আত্মহত্যা।

এর পেছনে মানসিক অস্থিরতাকে মোটা দাগে দায়ী করলেন বিশেষজ্ঞরা। আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান তানসেন রুজ বয়সভেদে আত্মহত্যার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ উদঘাটক করেছন।

হতাশা থেকে আত্মহত্যা

তিনি চট্টলার খবরকে বলেন, বয়সের তারতম্যের বিবেচনায় একেক জন একেক কারণে আত্মহত্যা করছেন।

মানসিক অস্থিরতায় বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তা ভর করছে। বন্ধু-সহপাঠীদের সাথে দেখা না হওয়ায় তার মধ্যে একাকীত্ব পেয়ে আসছে। পরিবারের কারো সাথে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে পারছে না। চেপে রাখছে নিজের মধ্যে। অন্যদিকে চাকরির প্রত্যার্শীরা হতাশা ও অবসাদে ভুগছেন। নিজের ভবিষ্যৎ ও পরিবারকে কিছু দিতে না পারার বেদনা প্রতিনিয়ত তাড়া করছে তাকে। হতাশা থেকে রেহাই পেতে গিয়ে তারা ভুল পথে পা বাড়ায়।

স্বাধীনতা ভোগ করার প্রয়াস সম্প্রতি টুনকো কারণে কিশোর ও তরুণদের আত্মহত্যা বিষয়টি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে অভিভাবক ও বিশেষজ্ঞদের।

এ বিষয়ে তানসেন রুজ বলেন, বয়ঃসন্ধিকালে সময়ে কিশোর ও কিশোরীদের মধ্যে এমনটা হয়ে থাকে। তারা পূর্ণ স্বাধীনতা আশা করেন। সে মনে করতে শুরু করে জীবনটা তার ইচ্ছেই চলবে। দেখা গেলো একজন কিশোর মোবাইলে গেইম খেলছে তাকে পরবর্তীতে মেবাইল না দিলে সে বিরূপ আচরণ করে। ভাত খাওয়া বন্ধ করে দেয়। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশী কেউ বকাঝকা করলে সে অভিমান করে বসে। অভিমানে সে নিজেকে শেষ করার ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নেয়। পারিবারিক কলহ গৃহবধূ ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার আত্মহত্যার কারণ হিসেবে পারিবারিক কলহ ও টানাপড়েনকে দুষছেন তানসেন।

তিনি জানান, লকডাউনের কারণে আয় কমে আসায় সে পরিবারের চাহিদা সেভাবে মেটাতে পারছে না। আয় পর্যাপ্ত না হওয়ায় সে নিজেকে ব্যর্থ মনে করে। অনেক সময় দেখা্ যায় সন্তানরা পিতামাতার খেয়াল রাখে না। ঠিকভাবে আচরণ করেন না। স্বামী- স্ত্রীর মতের মিল হয় না। পারিবারিক কলহ ও মানসিক অস্থিরতা থেকে এ বয়েসে মানুষ আত্মহত্যায় ধাবিত হয়। মানসিক অস্থিরতা পরিহারে পারিবারিক বন্ধনের ওপর জোর দিয়েছেনচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ও সহকারী অধ্যাপক লাইলুন নাহার।

তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে পারিবারিক বন্ধন কমে এসেছে। আমরা অধিকমাত্রায় অনলাইনে সময় পার করছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সন্তানরা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মিশতে পারছে না। রিফ্রেশমেন্টে পাচ্ছে না। গৃহবন্দী থাকায় তাদের মধ্যে হতাশা ও মানসিক অস্বস্তি কাজ করছে। পারিপার্শ্বিক কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সন্তানদের লালনপালন করতে মা বাসায় থাকছে।

বিভিন্ন সামাজিক অসঙ্গতি ও পারিবারিক মনমালিন্যের কারণে মা-বাবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন। যতই কঠিন সময় আসুক মানসিক অস্থিরতা বিষয়টি পরিবারকে জানাতে হবে। আমাদের মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে। পারিবারিক বন্ধন অটুট করতে হবে। সকলের সম্বলিত প্রচেষ্টা বাড়লে কিছুটা হলেও এর মাত্রা কমিয়ে আনা যাবে।

চখ/এএমএস

এই বিভাগের আরও খবর