শিশুদের অনলাইন গেইমে আসক্তি, বাড়ছে উদ্বেগ
রকিব কামাল : ছয় বছরের ছোট শিশু জারিন। নগরের জামালখান কুসুমকুমারী সিটি কর্পোরেশন স্কুলের ছাত্রী। বাসায় সে যেনও এক জীবন্ত পুতুল। তার হাসির ঝলকে সবাই হাসে, সামান্য ব্যথায় অস্থির হয়ে পড়েন সবাই।
বেড়ে ওঠা দুরন্ত জারিন কি পেলে খুশি হবে, তা হাজির করতে সর্বক্ষণ তৎপর থাকেন মা-বাবা। আর দশটা বাচ্চার মতো জারিনের খাবার খেতে নানা আপত্তি। শুধু মোবাইলে কার্টুন ছেড়ে দিলে দু-এক লোকমা খেতে চায়।
নিরুপায় হয়ে জারিনের মা সব সময় মোবাইল হাতে দিয়ে জারিনকে ভাতও খাওয়ান। মেয়ের আবদার রাখতে গিয়ে মা আয়সা খাতুন মোবাইলে বিভিন্ন গেইম নামাতে বাধ্য হন। প্রথম দিকে কার্টুন দেখলেও, পুরো দিন কাটে স্মার্টফোনে।
জারিনের মা চট্টলার খবরকে বলেন, প্রথম দিকে মোবাইলে কার্টুন দেখলেও এখন নানান ধরণের গেইম দেখার জন্য বায়না ধরে। মোবাইল না দিলে অনবরত কান্নাকাটি শুরু করে। কার্টুনের পাশাপাশি গেইম খেলার জন্য আজকাল তার বাবাকে বিরক্ত করে। করোনার কারণে সন্তানকে বাসার বাইরে যেতে পারছি না। বাধ্য হয়ে তাকে মোবাইল দিতে হচ্ছে।
কেবল জারিন নয়, এই চিত্র গৃহবন্দী অধিকাংশ শিশুর। দিনকে দিন শিশুরা মোবাইল, টেবসহ বিভিন্ন ডিভাইসে আসক্তি হয়ে পড়ছেন। নতুন বইয়ের ম-ম গন্ধ, শিক্ষকদের পাঠদান, দুরন্ত শৈশব ভুলে শিশুরা পাবজিতে ইচ্ছে মতো মানুষ মারছে, মেয়ে টিকটকে ওত পাতা আড়কাটির ফাঁদে বুদ হয়ে আছে। অনেকে অনলাইনের প্রাপ্ত বয়স্ক সাইটগুলোতে ডুকে পড়ছে, কেউবা নাম লেখাচ্ছে কিশোর গ্যাং-এ। করোনা সংক্রমণের কারণে বন্ধ রয়েছে দেশের সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সংকটকালীন সময়ে এর অভিঘাত যেনো থেমে নেই। সন্তানদের অনলাইনের সম্পৃক্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা ও সন্তানরা। এর সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনলাইনে ক্লাসের কারণে অভিভাবকরা বাধ্য হচ্ছেন সন্তানদের স্মার্টফোন তুলে দিচ্ছে। গেইমে আসক্তির ফলে শিশুরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
গৃহবন্দি সন্তানদের অনলাইন আসক্তি কমিয়ে আনতে অভিভাবকদের ভূমিকাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন সমাজ ও মনোবিদ বিষেশজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের দুরন্ত শৈশবে ফিরিয়ে আনতে সন্তানদের সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্তের পাশাপাশি বন্ধর মতো মিশতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সমাজতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক সুলতানা পারভীন চট্টলার খবরকে বলেন, অবশ্যই এটি উদ্বেগের বিষয়। আমাদের সামাজিক পেক্ষাপটে বিষয়টি আরও জটিল। আমাদের অভিভাবকরা বিষয়গুলো এড়িয়ে যান।
অভিভাবকদের যতই কাজ থাকুক না কেন, তাদের সন্তানদের জন্য সময় বের করতে হবে। অনেক সময় সন্তানরা না বলতে পেরে ভুলে পথে বা বাড়ায়। অন্তত সপ্তাহের দু-এক দিন হলেও তাদের বাসা থেকে বের হতে দিতে হবে। বাসার ছাদে ফল ও ফুলের বাগান, চিত্র অঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন সৃজনশীল বিষয়গুলোতে তাদের আগ্রহ বাড়াত হবে। পাঠ্য বস্তুকের বাইরে ভ্রমণ, দেশের মুক্তিযুদ্ধ, গল্প বই বড়তে উদ্বুদ্ধ করাতে হবে। অহেতুক সন্দেহ করা প্রবণতা বাদ দিয়ে সন্তানদের সাথে বন্ধুর মতো মিশতে শিখুন।
শিশুদের অনলাইনের সম্পৃক্ততার বিষয়টিকে মাদকাসক্তের সঙ্গে তুলনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ও সহকারী অধ্যাপক লাইলুন নাহার। তিনি চট্টলার খবরকে বলেন, হয়তো আরও দু-এক বছর এই মহামারির প্রভাব থাকবে। এমন অবস্থায় যে কোন সংকটকালীন মুহূর্তের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
বিশেষ করে সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজে আমাদের ইমামরা মোবাইলের ক্ষতিকর দিকগুলো শিশু ও অভিভাবকদের সচেতন করতে পারেন। এর পাশাপাশি মন্দির, গীর্জায়সহ বিভিন্ন উপাসনালয়ে আসা দর্শনার্থীদের নেতিবাচক দিকগুলো জানাতে পারেন।
প্রাপ্তবয়স্কদের অনলাইনে আসক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, এটি মাদকের চেয়ে ভয়াবহ। অনেক অভিভাবক এ দিকটা খেয়াল করেন না। বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের কারণে তারা স্বাধীনতা চায়।
এমন পরিস্থিতিতে তারা বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এখান থেকে ফেরাতে তারা কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কি করছেন সব কিছু মনিটরিং করতে হবে। কাউন্সিলিং করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যখন অ্যাসাইমন্টে জমা দিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবে, তখন শিক্ষকরা তাদের পড়াশোনা নিয়ে দিক নির্দেশনা দিতে পারেন।
এসএএস/চখ