chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

সঞ্চয় ভেঙে চলছে জীবন, নীরবে কাঁদছে মধ্যবিত্তরা

ইফতেখার নিলয়:  করোনার দ্বিতীয় ঢেউ গ্রাস করে ফেলেছে গোটা বাংলাদেশকে। আকস্মিক করোনা পরিস্থিতির এমন অবনতিতে লকডাউন বাস্তবায়ন ব্যতীত, পরিস্থিতি স্বাভাবিকে আনার কোনোপ্রকার পন্থা খোলা ছিলোনা সরকারের। আর এই লকডাউনে আয়শূন্য হয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জীবন চলছে সঞ্চয় ভেঙে। কঠিন এই পরিস্থিতিতে নীরবে কাঁদছে মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা।

চলতি বছরের মার্চের মাঝামাঝিতে দেশে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যায়। এরপর থেকে সরকার কর্তৃক শুরু হয় তড়িঘড়ি করে জনগণকে সচেনতার জালে পুনরায় আবদ্ধ করার প্রচেষ্টা। সকল স্তরের মানুষকে পুনরায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন-যাপন করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিশেষ করে করোনার সংক্রমণ নিম্নগামী হওয়ার পর, স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক শিথিলতার ঘোষণা না দেওয়া হলেও, দেশের জনসাধারণের মাঝে কমে যায় তা মেনে চলার প্রবণতা। কয়েকদফা তাগিদ দিয়েও সম্ভব হয়নি দেশের মানুষকে সচেতন করা।

তাই করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এপ্রিলের ৫ তারিখ থেকে ৭ দিনের লকডাউন ঘোষণা করা হয়। যদিও সে লকডাউনে সকল ধরণের অফিস চালু রাখা হয়। সকল অফিস চালু থাকায় লকডাউনেও পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের বেরিয়ে আসতে হয়েছিলো বাড়ির বাইরে। যার ফলে করোনা হ্রাসের চেয়েও আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। পরের সপ্তাহে দেশব্যাপী ঘোষণা করা হয় কঠোর লকডাউন।

কঠোর লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে দূর্বিষহ যন্ত্রণায় রয়েছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা। কেননা, লকডাউনে কমে যায় একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তির আয়। কিন্তু থেমে থাকেনা তার প্রাত্যহিক জীবনের খরচ। পরিবারের সদস্যদের তিনবেলা খাবারের যোগান, ঘরভাড়া থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল। এমনকি বর্তমানে সন্তানের অনলাইন ক্লাসের জন্যেও যুক্ত হয়েছে বাড়তি খরচ। এর ফলে মধ্যবিত্তরা সকল খরচ চালাতে গিয়ে পড়েছেন বিপাকে। করোনা নিয়ন্ত্রণে অনেকেই লকডাউনকে সমর্থন জানালেও তাদের দ্বারাও সম্ভব হচ্ছেনা এই দুঃসহ সময়ে স্বাভাবিক জীবন পরিচালনা করা।

নারীদের সাজসজ্জার প্রসাধনী আমদানীকারক চট্টগ্রামের যুবক সাজ্জাদুল কাদের লকডাউনে জীবন ও জীবিকা সম্পর্কিত উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে চট্টলার খবরকে বলেন, ‘আমার পরিবারে আমিই বড় ছেলে, বাবার অবসরকালীন সময়ে পরিবারের দায়িত্ব আমার হাতে। কিন্তু লকডাউনে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা শোচনীয়৷ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও ওষুধ ছাড়া অন্যান্য পণ্য নিয়ে আমার মতো যারা ব্যবসায়ী আছে তারা হিমশিম খাচ্ছে সংসার চালাতে। এভাবে টানা চলতে থাকলে আমরা মধ্যবিত্তরাই সবচেয়ে বেশি দূর্ভোগে পড়বো। কারণ উচ্চবিত্তদের মতো না আমাদের অর্থ সম্পদ আছে, না নিম্নবিত্তদের মতো আমরা অর্থ সাহায্য চাইতে পারি। মোটকথা করোনায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় মধ্যবিত্তরাই রয়েছে।’

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে দাম নিয়েও মধ্যবিত্তদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। লকডাউনের মাঝেই রমযান চলে আসায় প্রতিটি পরিবারে যোগ হয়েছে বাড়তি খরচ। কিন্তু রমযানের দুই সপ্তাহ আগে থেকেই বাজারে চাল, চিনি, ছোলার দাম ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় উভয়সংকটে পড়েছেন মধ্যবিত্তরা। তাদের দাবি আয়হীন জীবনে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতিতে তারা ক্রয়ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেন।

এ বিষয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আব্দুস সামাদ চট্টলার খবরকে বলেন, ‘আমাদের আয় ও ব্যয়ের সামঞ্জস্য কখনোই হয়না। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অনেক পুরাতন সমস্যা। মধ্যবিত্তরা নিজেদের কষ্ট কারো কাছে বলতে পারেনা তাই ধার করে বা সঞ্চয় ভেঙে তাদের জীবনযাপন করতে হচ্ছে বর্তমানে। গতবছর লকডাউনেও আমরা একই পরিস্থিতিতে ছিলাম। সম্মানের কথা ভেবে কারো কাছে হাত পাতাও সম্ভব হয়না আমাদের দ্বারা। বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম ও লকডাউন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আমাদের একপর্যায়ে সম্মান ভুলে ভিক্ষায় নামতে হবে।’

করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাই সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চললে সামনে আরো ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে বলে নিয়মিত সতর্কবার্তা দিয়ে যাচ্ছে বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে সরকার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়মিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি স্বাভাবিকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু রোজগারশূন্য মানুষদের কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়মিতই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। অনেকেই ইতোমধ্যে শহরের বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে পাড়ি জমিয়েছেন। এমনকি গতবছর লকডাউনে চাকরি হারিয়ে শহর ত্যাগ করা অনেকেই এখনও সবকিছু গুছিয়ে উঠে শহরের জীবনে বসবাস শুরু করতে পারেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের মত নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের কাছে লকডাউন এক আতঙ্কের কারণ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে তাল মিলিয়ে পারিবারিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিদিন। বাসাভাড়া পরিশোধ করতে অক্ষম হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে বসবাসরত অনেক অস্থায়ী বাসিন্দা পাড়ি জমিয়েছেন গ্রামের স্থায়ী ঠিকানার উদ্দেশ্যে। চাকরিচ্যুত হয়েছেন অসংখ্য বেসরকারি কর্মকর্তা – কর্মচারী। একদিকে করোনা ভয়াবহতা, অন্যদিকে পারিবারিক ও আনুষঙ্গিক প্রয়োজন পূরণ করতে পারার অনিশ্চয়তা নিয়ে শুরু হয় মধ্যবিত্তদের প্রতিদিনের সকাল।’

অবসরকালীন সময়ের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া বৃদ্ধ বাবা ও পরিবারকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করা তরুণ উদ্যোক্তারাও রয়েছেন একই সমস্যায়। ঈদের মৌসুমে ক্রেতাদের সাড়া পাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়ের খ্যাতি অর্জনের আশা এখন অনেকাংশেই রূপ নিয়েছে অনিশ্চয়তায়।

চট্টলার খবরকে এ ব্যাপারে তরুণ উদ্যোক্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘অনলাইন ব্যবসা মোটেও সহজ বিষয় নয়! এখনকার সময়ে অনালাইনে ক্রয়ের প্রতি ক্রেতাদের ঝোঁক বাড়লেও ক্রেতাদের মন বোঝা দায়! সবনিম্ন লাভ নিয়ে অনলাইনে সন্তুষ্ট থাকতে হয় ক্রেতার মন ও ব্যবসায়ের সুনাম রক্ষায়। এরপরেও ক্রেতা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে লকডাউনের কারণে। অনেকের ধারণা বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ বলে অনলাইন ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছেন ঈদের মৌসুমে। কিন্তু এর চিত্র পুরোটাই বিপরীত৷ মানুষের কাছে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় অনলাইনেও তাদের দ্বারা ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছেনা, এক্ষেত্রে আমরাও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। পরিবারকে সহযোগিতা করার আশায় শুরু করা ব্যবসা এখন পথ হারিয়ে বিলীন হতে যাচ্ছে।’

করোনার প্রাদুর্ভাবের হার ঊর্ধমুখী হওয়ার পর থেকে কমেছে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, পাশাপাশি কমে গেছে মানুষের আয়। জীবন ও জীবিকা দুটোই এখন একইসাথ হুমকির সম্মুখীন। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সকলকিছু ক্রয় করাও অসম্ভব মধ্যবিত্ত পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির দ্বারা।

শহরের অভ্যন্তরে গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে, তবে ১৬ই মে পর্যন্ত বেড়েছে লকডাউনের মেয়াদ। ঈদেও চলবে লকডাউন। আক্রান্ত ও মৃত্যুহার না কমলে লকডাউন উঠার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে নানান রকমের পরিকল্পনা থাকলেও তা এখন ভেস্তে গিয়েছে সবার। করোনার ক্রান্তিকাল কাটিয়ে লকডাউনবিহীন জীবন ও জীবিকার সঠিক নিশ্চয়তাই এনে দিতে পারে মধ্যবিত্তদের জীবনে ভরপুর ঈদের আনন্দ।

এই বিভাগের আরও খবর