মাস্ক ও পিপিই’র সাথে বসবাসের এক বছর
ইফতেখার নিলয় : চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া অজানা এক ভাইরাস ধীরে ধীরে হানা দিতে শুরু করে সমগ্র বিশ্বে। চীনে অধ্যয়নরত বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা তড়িঘড়ি করে ছুটতে লাগলো নিজ দেশের ঠিকানায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে অবস্থান করা ছাত্র-ছাত্রীরা পড়ে তীব্র খাবার সংকটের সমস্যায়। পুরো চীন তখন করোনা থাবায় লকডাউনে আবদ্ধ। প্রাণ বাঁচাতে যে যার দেশে এখন ফিরে যেতে ব্যাকুল। বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীরাও দেশে ফিরতে শুরু করে ধাপে ধাপে।
দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গুলোয় নেওয়া হয়েছে বাড়তি সতর্কাবস্থা। নিয়ম অবজ্ঞা করে আসা-যাওয়ার সুযোগ আপাতত বন্ধ। মহামারি করোনাভাইরাস সারাবিশ্বে যেভাবে ছড়িয় পড়েছে তা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে আর বেশি দেরি নেই তাই ছিলো অনুমেয়। এবং ঠিক তাই হলো। ২০২০ সালের ৮ই মার্চ পড়ন্ত বিকালে পূর্বে নাম না জানা এক প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের সংবাদ সম্মেলনে টিভি পর্দায় সবার উৎসুক দৃষ্টি। ঘোষণা আসলো প্রথম করোনা রোগী সন্ধানের।
আইইডিসিআর কর্তৃক বেঁধে দেওয়া হলো সুস্থ থাকার নানান নিয়ম-কানুন। বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বেরোনোর ব্যাপারে এলো নিষেধাজ্ঞা। ঘরের বাইরে বের হলে বাসায় এসে নিয়মিত মাস্ক পরিধানের পাশাপাশি ঘরে ফিরে সাবান পানি দিয়ে হাত ধোঁয়ার নিয়ম বাতলে দেওয়া হলো সর্বদা সুরক্ষিত থাকতে। মনুষ্য অভিধানে নতুন করে যোগ হলো কোয়ারেন্টিন আর লকডাউন নামক দুটি ইংরেজি শব্দ। চতুর্দিক থেকে উঠলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্রুত বন্ধ করে দেশ লকডাউন করার জোরালো দাবি। প্রথম করোনা শনাক্তের ৮ দিন পর অবশেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হলো। সীমিত হয়ে আসলো মুজিববর্ষের কার্যক্রম।
দেশের প্রথম অঞ্চল হিসেবে লকডাউন নেমে আসলো মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায়। এরপর সকল জেলাই অনুসরণ করতে শুরু করে শিবচরের সিদ্ধান্তের পদাঙ্ক। সরকার কর্তৃক সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো ২৬শে মার্চ থেকে ৪ঠা এপ্রিল পর্যন্ত। কয়েক দফা বৃদ্ধি পায় এ ছুটি, তবে আকস্মিকভাবে দেশের সকল পোশাক কারখানা খুলে দেয়া হয়। যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় পায়ে হেঁটে সবাই পাড়ি দিলো ঢাকামুখী পথ। কেউ কেউ চাকরি বাঁচাতে ট্রাকের ভেতর ড্রামে আশ্রয় নিয়ে রওনা হয়েছিলেন। এমন কঠিন দৃশ্যে সমালোচিত হয়েছিলো দেশের পোশাক শিল্প মালিকদের এমন অমানবিক সিদ্ধান্তের।
একদিকে হু হু করে বাড়ছিলো করোনা আক্রান্তের সংখ্যা আর অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিলো মৃতের সংখ্যা। মৃত ব্যাক্তিদের লাশ দাফন নিয়েও বিড়ম্বনায় পড়তে হয় স্বজনদের। মৃত লাশ থেকেও করোনা ছড়াতে পারে এমন গুজবে লাশ দাফন করতে গিয়ে বাঁধাগ্রস্ত হয় স্থানীয় মানুষ দ্বারা। প্রিয় স্বজনের লাশ শেষবারের মত দেখার নেই সুযোগ, নেই জানাযায় অংশ নেওয়ারও অনুমতি। ব্যাপক কষ্টে কাটাতে হচ্ছিলো প্রতিটা দিন। সামাজিক দূরত্ব, ত্রাণ সরবরাহ, সঠিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতকরণে তুমুল অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে।
করোনা থাবায় বছরব্যাপী সকল ধরণের উৎসবের আনন্দ বিলীন হয়ে গিয়েছিলো গৃহবন্দি থেকে। রোযা, ঈদ, পূজা, বৈসাবিসহ অন্যান্য সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আনন্দে পড়েছিলো ভাটা। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকঙ্ক্ষীদের সাথে সাক্ষাতে নিষেধাজ্ঞা নেমে আসায় এক নিষ্ঠুর পৃথিবীর অভিজ্ঞতা হয়েছিলো সবার।
মহামারিকালীন সময়ে রোজগার নিয়েও তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। অর্ধেক বেতনে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিলো উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। পাশাপাশি অসংখ্য ব্যক্তি হয়েছিলেন চাকরিচ্যুত। তাদের জন্য সরকারি প্রণোদনার ঘোষণা এলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের লোভী আচরণে অনেকেই বঞ্চিত হয়েছিলেন সরকারি প্রণোদনা থেকে। অন্যদিকে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে রোগী ভর্তি না নেওয়ারও অভিযোগ উঠে। কয়েক হাসপাতাল ঘুরে সবশেষ ঢলে পড়তে হয়েছিলো মৃত্যুর কোলে। এমন সময় দেশের সংকটাবস্থায় এগিয়ে আসে বিদ্যানন্দের মত অসংখ্য সামাজিক সংগঠন।
এলাকাভিত্তিক লকডাউন কার্যক্রম পরিচালনায় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নিয়োগপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবকদের৷ নজরে এসেছিলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনার বিষয়বস্তু। গৃহবন্দী জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা রূপ নিয়েছিলো কারাগারের অনুভূতিতে৷ একদিকে রোজগারশূণ্য জীবন, আরেকদিকে গৃহবন্দী। মানুষগুলো মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করল। করোনা একজন কে যতটুকু আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলো, তার সমপরিমাণ ক্ষতি করেছিলো মানসিকভাবে। প্রতিদিন টিভি পর্দায় ক্রিকেটের স্কোরকার্ডের মত আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা দেখে আতঙ্ক যেন বেড়েই যাচ্ছিলো।
সময় বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে সাধারণ ছুটি বিদায় নিলো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবদিকেই এলো স্বাভাবিক জীবন-যাপনের ঘোষণা। কিন্তু থামেনি করোনা সংক্রমণ আর মৃত্যুর মিছিল। মাস্ক আর পিপিইর সাথে বসবাস চলতেই থাকলো সাধারণ মানুষের। করোনা থাবায় থমকে যাওয়া জীবনে স্বাভাবিকতা ফিরে আসলেও দ্বিগুণ বেড়েছে স্বজন হারাদের আক্ষেপ ও বেদনা।
সবকিছু কে ছাপিয়ে নতুন সময়ের সন্ধানে করোনা টিকা আসলো দেশে। করোনার সাথে বসবাসের এক বছরও পার হলো। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সকলেই শুরু করলেন করোনা টিকা গ্রহণ। একদিন করোনা নিঃশেষ হবে, সে আশায় সবাই মুখিয়ে আছে। টিকার প্রথম ডোজ নিয়ে বাকিদের অপেক্ষা দ্বিতীয় ডোজের। করোনা থাবা কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বীরদর্পে এগিয়ে চলার দিন শুরু হোক করোনা টিকা গ্রহণ অধ্যায়ের মাধ্যমে। করোনার মত মহামারিকালীন সময় সারাবিশ্বে আর কখনোই ফিরে না আসুক। স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন করুক বিশ্ববাসী।
দেশের এই মহামারি কালীন সময়ে যারা পুরো এক বছর সময় ধরে সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে লড়ে গেছেন দেশকে নিরাপদ রাখতে এবং যারা এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের প্রতি রইলো চট্টলার খবরের বিনম্র শ্রদ্ধা।
নচ/চখ