chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

টেস্ট শিখতে কত দূর?

ইফতেখার নিলয়: টেস্ট ক্রিকেটের বয়স দুই দশক পেরিয়েছে আমাদের। দল হিসেবে পরিপক্ব হওয়া তো দূরের কথা, প্রাথমিক জ্ঞান লব্ধ করার পাঠ চুকানোই সম্ভব হয়নি আজও। বিশ বছর আগের ইতিহাস ও বর্তমান সময়ের গল্পে নেই উল্লেখ করার মতো তফাৎ। ব্যক্তিগত অর্জনে রঙিন হওয়া ক্রিকেটারেরাও পারেনি দলকে পরিপূর্ণ করতে। ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচকদের একাদশ গঠনেই আসেনি পরিপক্বতা। 

চট্টগ্রামের প্রথম টেস্ট দিয়েই ভুলের পোস্টমর্টেম শুরু করা যাক।

সৌভাগ্যের তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিত জহুর আহমেদের মাঠ। টেস্টের চতুর্থ দিন পর্যন্ত এবারও এই উক্তির যথার্থতা প্রমাণ হয়েই যাচ্ছিলো। পঞ্চম দিনে উল্টো ঘুরতে শুরু করে ম্যাচের চাকা কাইল মায়ার্স ও বনারের ব্যাটিংয়ে। চালকের আসনে থাকা বাংলাদেশ, ম্যাচের লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ মূলত একাদশ নির্বাচন, রিভিউ না নেওয়া, ফিল্ডিং, নির্বিষ স্পিন, অধিনায়কত্ব ও বাড়তি একজন পেসারের অভাবে।

চন্ডিকা হাতুরাসিংহের বাতলে দেওয়া এক পেসার তত্ত্বে সাময়িক কিছু সাফল্য পাওয়া গেলেও, এটাই চূড়ান্ত হতে পারে না। নিয়মিত সাফল্য এই কৌশলে ধরা দিবে না, এটাই ছিল অনুমেয়। চট্টগ্রাম টেস্টে অনুমেয়’র ব্যতিক্রম কিছুই ঘটেনি। মোস্তাফিজ নিঃসঙ্গ ছিলেন স্পিনারদের ভিড়ে। একটানা স্পিন মোকাবিলা করে মাঠে থিতু হয়ে যাওয়া উইন্ডিজদের ভড়কে দেওয়া সম্ভব হয়নি এক মোস্তাফিজে। স্লিপ ফিল্ডারদের ব্যর্থতায় মোস্তাফিজও বঞ্চিত হয়েছে দুয়েকটি সফলতা থেকে। তারপরেও এটাকেই চূড়ান্ত ধরে নেওয়া হলে সাদা পোশাকে কখনোই আউট অফ দ্যা বক্স কিছু করা সম্ভব নয় বাংলাদেশের।

পাশাপাশি সিনিয়রদের ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন সুফল বয়ে আনেনি মোটেও, সাকিব-মুশফিককে তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা থেকে সরানো প্রশ্নসাপেক্ষ । সাকিব রান পেলেও মুশফিক ব্যর্থ হয়েছেন পুরোপুরি।

সাদমানের দুর্দান্ত ইনিংসের ইতি টানতে হয়েছে আম্পায়ারের ভুলে, এক্ষেত্রে আম্পায়ারকে কতটুকু দোষ দেওয়া যায়! অপরপ্রান্তে অভিজ্ঞ মুশফিক থাকার পরেও রিভিউ না নেওয়া তো ১৫ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মুশফিকের পরিপক্বতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। রিভিউ নেওয়ার ক্ষেত্রে বরাবরই বাংলাদেশের দুর্বলতা, তবে মুশফিকের কাছে এমনকিছু মোটেও কাম্য নয়। মাঠে সিনিয়রদের এমন ভুল মূহুর্তেই দলকে ছিটকে দেয় ম্যাচ থেকে।

এতকিছুর পরেও চারশোর কাছাকাছি লক্ষ্য টেস্ট ক্রিকেটে প্রায়ই অসম্ভব ব্যাপার চতুর্থ ইনিংসে। কিন্তু হায়! ভরপুর স্পিনার নিয়ে মাঠে নেমেও পিচ থেকে পাওয়া যায়নি ন্যূনতম সহায়তা। সাকিবের ইঞ্জুরি কমিয়েছে দলের শক্তি। তাইজুল, মিরাজ, নাঈম কারো কাছ থেকেই অতিচমকপ্রদ কিছুর অভাবে বাংলাদেশের হতে যাওয়া ম্যাচ, নিজেদের করে নিয়েছে উইন্ডিজরা।

তিন স্পিনার কে একেবারে ছেলেখেলা বানিয়ে ছেড়েছে কাইল মায়ার্স ও বনার। এক পেসার নিয়ে তো প্রতিরোধ সম্ভব ছিল না, নির্বাচক প্যানেলের অদূরদর্শিতা ফল হিসেবে অনভিজ্ঞ উইন্ডিজ দলের বিপক্ষে এই পরাজয় বাংলাদেশের প্রাপ্য।

মুমিনুলের কাছে দায়িত্বাভার এসেছে এক প্রকার অসম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই। সাকিবের নিষেধাজ্ঞা, ও রিয়াদের দলে নড়বড়ে অবস্থানে মুমিনুলকে দেওয়া দায়িত্ব সুফল বয়ে আনেনি দলের জন্য। সিদ্ধান্ত নিতে এখনও হিমশিম খেতে হয় তাকে। অধিনায়ক হয়েও এমন অনিশ্চয়তায় থাকা কাপ্তান দ্বারা সম্ভব নয় দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া। চাপের মূহুর্তে বোলারকে অনুপ্রেরণা দেওয়া, ফিল্ডিংয়ে পরিবর্তন আনা, দলের সবাইকে একত্র করে কথা দ্বারা চাঙা করা, সতীর্থদের পিঠ চাপড়ে সাহস দেওয়া, অ্যাটাকিং ফিল্ডিং তৈরি করা; কোনোটাই দেখা যায়নি মুমিনুলের কাছ থেকে।

মুমিনুলের শরীরী ভাষা টিভি পর্দায় কিংবা গ্যালারি থেকে দেখে নিশ্চিত করা সম্ভব নয় তিনি অধিনায়ক। ব্যাট হাতে দারুণ করলেও, অধিনায়কত্বে মুমিনুল ছিলেন একেবারেই ডিফেন্সিভ কিংবা নিষ্প্রাণ। দুই সিনিয়র সাকিব-তামিমের মাঠে অনুপস্থিতিতে মুমিনুলও পায়নি পর্যাপ্ত সহযোগিতা বাকিদের কাছ থেকে। মাঠে উপস্থিত থেকেও অনেকখানি নীরব ছিলেন মুশফিক।

মাঠের চেয়েও অধিনায়কের সংবাদ সম্মেলনের ভূমিকা ছিল হতাশাজনক। পরাজয়কে ডিফেন্ড করতে গিয়ে তিনি পাড়ার ক্রিকেটের যুক্তি তুলে বলেন, ‘এটাই গোল বলের খেলা।’

বাংলাদেশ হেরেছে, হারতেই পারে। খেলাধুলা তো জয় পরাজয় নির্ভর। হয়তোবা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে সবার কাছে। ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছি, এই বুলি নিশ্চয়ই এবার বাস্তবে কাজে লাগাবে নির্বাচক থেকে শুরু করে মাঠের এগারো জন। একাদশে নিশ্চয়ই একজন বাড়তি পেসার খেলানো হবে ঢাকা টেস্টে। সাকিব ও সাদমান ইঞ্জুরিতে দলের বাইরে। সাদমানের জায়গায় স্কোয়াডের ব্যাকাপ ওপেনার সাইফ তো আছে৷ কিন্তু না, একাডেমি মাঠে আসন্ন নিউজিল্যান্ড সফরের জন্য নিজেকে প্রস্তত করা সৌম্যের আকস্মিক দলে অন্তুর্ভুক্তি।

এতে করে সাইফের মনোবলে আঘাত দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের সিদ্ধান্তের উপর নিজেরাই আস্থা হারানোর প্রমাণ দিলেন নির্বাচকরা। আচ্ছা যাই হোক… পেসার তো দুইজন অন্তত পাওয়া যাবে এবার। নাহ… ভুল থেকে শিক্ষা নেয়নি নির্বাচকরা। এবারও এক পেসার, আবু জায়েদ রাহি। মোস্তাফিজ নিজেও জানেন কি না তার বাদ পড়ার কারণ! তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এক সিরিজেই নিজেদের দৈন্যতার প্রমাণ দিয়ে গেছেন নির্বাচকরা। হিমশিম খেয়েছেন দল তৈরিতে। অথচ ডাগআউটে অযথাই বসে ছিলেন স্কোয়াডের বাকি চার পেসার। নির্বাচকদের এমন সিদ্ধান্তে দলে নিজেদের প্রয়োজনীয়তা কী এটা ভেবেই মনোবল হারাতে হারাতে পারেন তারা।

টেস্টে পেসারদের ভূমিকা অত্যাধিক। সুইং ও গতি দিয়ে ব্যাটসম্যানদের নাজেহাল করে দিয়েই টেস্টে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়। দলে তাসকিন, এবাদতের মত স্পিডস্টার থাকার পরেও তাদের একাদশে রাখা হয়নি। নিয়মিত এদের দিয়েই সফলতা খুঁজতে হবে। নিজেদের সম্পদকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে টিম ম্যানেজমেন্ট কবে দায়িত্বশীল হবে?

মিরপুরে দ্বিতীয় টেস্টে রাহি বল দু-দিকেই সুইং করিয়েছেন। সৌম্যকে তার পাশে বোলিং করিয়ে দলে দুই পেসারের রাখার দায়িত্ব কোনোমতে সারা গেলো। রাহি দুই ইনিংস মিলিয়ে ৬ উইকেট শিকার করেছেন। আগের টেস্টে তাকে না রাখার সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণ করলেন। তবে তিনিও যে সঙ্গীহীন ছিলেন, প্রমাণ হয়েছে দুই ইনিংসেই।

সৌম্যকে দলে রাখার সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে। যার প্রমাণ সৌম্য নিজেই দিলেন দুই ইনিংসে ব্যর্থ হয়ে। এতদিনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেও তামিম নিজের মাঝে শট সিলেকশনে পারদর্শিতার অভাব বুঝিয়েছেন। দুই ম্যাচেই প্যাভিলিয়নের পথ ধরেছেন লুজ শটে। শান্তর ব্যর্থতার গল্প হরহামেশা ব্যাপার। প্রথম ইনিংসে সিক্স স্ট্যাম্পের বল ড্রাইভ করার মত আত্মঘাতী শটে উইকেট বিলিয়ে দিলেন, দ্বিতীয় ইনিংসে দেখালেন বলের উপর তার ব্যাটের নিয়ন্ত্রণের অভাব।

দলকে পথ দেখিয়েও প্রথম ইনিংসে দায়িত্বজ্ঞানহীন রিভার্স সুইপে মুশফিক বিদায় নিয়েছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যর্থ আবারও স্পিনে। ব্যাট হাতে কেবল লিটন আর মিরাজ প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও বাকিরা ছিলেন আসা-যাওয়ার মিছিলে। দ্বিতীয় ইনিংসে মিরাজের ছোটো কাঁধে যারা এতবড় চাপ তৈরি করে দিয়েছিলেন, এই টেস্ট ম্যাচ নষ্ট করার মূল কারিগর তারাই। মিরাজ নয়, তারাই হারিয়েছে এই টেস্ট ম্যাচ।

সিনিয়র ক্রিকেটার ও টিম ম্যানেজমেন্টের ব্যর্থতা-ই খর্বশক্তির এই উইন্ডিজ দলের কাছে নাজেহাল হতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ঘরের মাঠে ডুবতে হয়েছে হোয়াটওয়াশের লজ্জায়। এটাকে লজ্জা বলাও ভুল হবে, টেস্ট ক্রিকেটের পথচলায় এমন ঘটনায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ।

ঘরোয়া লীগে মানহীন পিচ, প্রতিযোগিতার অভাব, টেস্টের মানসিকতা বৃদ্ধির কাজ না করা, একাদশ নির্বাচনে অপরিপক্বতা। সবকিছু মিলিয়ে সমন্বয়ের অভাবেই টেস্ট ক্রিকেট রপ্ত করা সম্ভব হয়নি বাংলাদেশের। দু-দশকের টেস্ট ক্রিকেটে যা জয় এসেছে, এগুলো নিছক দুর্ঘটনা ছাড়া আরকিছুই মনে হবে না এভাবে চলতে থাকলে।

এমআই/চখ

এই বিভাগের আরও খবর