chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

অস্বাস্থ্যকর খাবার দোকানে সয়লাব নগরী

পোড়া তেলে ভাজা, পচা-বাসি খাবার পরিবেশনের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক : বিধিবহির্ভূতভাবে রাস্তার পাশে গড়ে তোলা হয়েছে রান্নাঘর। আর সেখানেই অস্বাস্থ্যকর, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি হচ্ছে খাবার। খাবার তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে  পোড়া তেল। আর সেখানেই অবলীলায় পরিবেশিত হচ্ছে পচা-বাসি খাবার।

নগরীর অলি-গলি, পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে, বিভিন্ন অফিসপাড়ার আশেপাশে এ ধরনের হোটেল- রেস্তোরাঁর সয়লাব। আর সেখানেই মারাত্বক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন খাবার গ্রহণ করছেন এই নগরীর লক্ষাধিক ব্যস্ত মানুষ।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান চট্টলার খবরকে বলেন, খাবারের মান নিশ্চিত করতে প্রতিমাসে গড়ে ১৫ টার অধিক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারপরও এটা সন্তুষজনক নয়।

নগরীজুড়ে নকল-ভেজালের বিরুদ্ধে বছরজুড়ে অভিযান চললেও কাঙ্কিত সুফল মিলছে না। লঘু সাজার কারণে নকল-ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্য কিছুতেই থামছে না। অবাধে বিক্রি হচ্ছে মানহীন পণ্য। এর ফলে ক্রেতারা যেমন প্রতারিত হচ্ছে, তেমনি হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য।

বাংলাদেশে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি চট্টগ্রাম মহানগরীর তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরীতেই ছোট-বড় মিলিয়ে দুই হাজারের বেশি হোটেল-রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে সমিতিভুক্ত রয়েছে মাত্র তিন শতাধিক এবং সাইনবোর্ডধারী হোটেল- রেস্তোরাঁ রয়েছে এক হাজার থেকে এক হাজার দুইশো।

বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ-২০১৬ (সংশোধিত) বিধি অনুসারে দেশের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোকে এ, বি, সি ও ডি এই চার ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। সবশ্রেণির রেস্তোরাঁর জন্যই রয়েছে ন্যূনতম ২৪ ধরনের বিধি। পরিষ্কার রান্নাঘর, রান্না ও বাসনপত্র ধোয়ার পরিষ্কার বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার, রান্নায় ভালো বা ফ্রেশ তেল ব্যবহার, পরিবেশনকারীদের নির্দিষ্ট পোশাক।

এছাড়া খাবার টেবিলে রান্নাঘরের ধোঁয়া আসা যাবে না, উচ্ছিষ্ট খাবার অপসারণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত ওয়াশরুম, এ ও বি শ্রেণির জন্য ন্যূনতম দুটি টয়লেট, সি এবং ডি শ্রেণির জন্য কমপক্ষে একটি টয়লেট, প্রশিক্ষিত বাবুর্চি দিয়ে রেস্তোরাঁ পরিচালনা, প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের ব্যবস্থা ও নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা থাকতে হবে বিধি অনুসারে। যুক্তিসংগত মূল্য তালিকা, অভিযোগ বাক্স থাকা, বেচে যাওয়া খাবার যথাযথ সংরক্ষণব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়গুলোও রয়েছে বিধিতে। বাসি বা পুরনো তেল ব্যবহার ও উন্মুক্ত স্থান বা রাস্তার পাশে রান্না নিষিদ্ধ করা হয়েছে বিধিতে।

চট্টগ্রাম নগরী এবং এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব বিধির কোনোটিই ঠিকমতো মানছে না হোটেল রেস্তোরাঁগুলো। কিছু নামি-দামি হোটেল-রেস্তোরাঁ এসব বিধি মানলেও মাঝেমধ্যে তাদের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উঠছে।

নগরীর চকবাজার, জিইসি, আগ্রাবাদ, দেওয়ানহাট, বহদ্দারহাট, আন্দরকিল্লা, রিয়াজুদ্দিন বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, কোনো রেস্তোরাঁতেই ভালো কোনো টয়লেট নেই। আগের দিনের পোড়া তেল ফেলে দেওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রতিটিরই রান্নাঘর রয়েছে রাস্তার পাশে এবং ধোঁয়াগুলো ঠেলে দেওয়া হচ্ছে রাস্তার দিকে। বাতাস যাচ্ছে রেস্তোরাঁর ভেতরেও। কর্মচারীদের নেই পরিচ্ছন্নতার বালাই।

লাইসেন্স দেওয়ার আগে নিশ্চিত করা হচ্ছে না এসব হোটেল-রেস্তোরাঁর পরিবেশ ও মান। ফলে একদিকে ভোক্তারা ঠকছে খাবারে, অন্যদিকে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। দিনের পর দিন এভাবে চললেও দেখার কেউ নেই। নামমাত্র কিছু অভিযানে সীমাবদ্ধ তদারকির কার্যক্রম। মানের ভিত্তিতে গ্রেডিং করার কার্যক্রমও থেমে আছে। জরিমানাই স্থায়ী সমাধান নয় বলে মনে করছেন খোদ রেস্তোরাঁ মালিকরাও। লোক-দেখানো অভিযানের পরিবর্তে লাইসেন্স দেওয়ার আগেই সব কিছু যাচাই-বাছাই করার কথা বলছেন তাঁরা।

এমনিতেই মানহীন কিংবা ভেজাল পণ্য উৎপাদকদের শাস্তি খুব একটা হয় না। এ ছাড়া পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতারও অভাব আছে। নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর থাকলেও তার তৎপরতাও সীমিত। ভেজাল ও মানহীন পণ্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান অনেকাংশেই বাণিজ্য নগরীতে সীমিত। নগরীর বাইরে তৎপরতা নেই বললেই চলে। ভেজাল বন্ধে নকল ভেজাল অপরাধের দণ্ড বাড়াতে হবে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গেল বছর তিনশ এর অধিক অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে জরিমানা করা হয়েছে লক্ষাধিক টাকা।

বিভিন্ন সংস্থার অভিযানেও উঠে আসছে নানা অনিয়মের চিত্র। গত ৬ জানুয়ারি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে তেলাপোকা, ময়লা-আবর্জনাপূর্ণ স্থানে খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত ও সংরক্ষণ, কিচেনে খোলা ডাস্টবিন রাখা, রংদেয়া করমচাকে চেরি হিসেবে ব্যবহার এবং ময়লা ও তেলাপোকাযুক্ত ফিরনি বিক্রয়ের জন্য সংরক্ষণ করায় অলংকার মোড়ের কুটুম্ববাড়ি রেস্টুরেন্টকে ৫০ জরিমানা করে সতর্ক করা হয়।

হোটেলের মান নির্ধারণে রাজধানীতে গ্রেডিং সিস্টেম চালু করা হয়েও চট্টগ্রামে তা এখনো চালু করা হয়নি। তবে শিগগিরই চট্টগ্রামে ঢাকার মতো গ্রেডিং সিস্টেমের আওতায় আনার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলার নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা নাজমুস সুলতানা সীমা।

তিনি বলেন, গেল বছরের ১৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর মুজিব জন্মশত বর্ষ উপলক্ষে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় নিরাপদ খাদ্য কর্মসূচী পালন করছেন। এরপর চট্টগ্রামের খাবার হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোকে একটি গ্রেডিং সিস্টেমের মধ্য আনা হবে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, খাদ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত ডিডিটিসহ কার্বামেড, কার্বাইড, ক্রোমিয়াম, অ্যালড্রিন, আর্সেনিক, ফরমালিনের মতো অনেক বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এগুলো মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টি, লিভার ও কিডনি অকেজো করে দেওয়াসহ বহু প্রাণঘাতী রোগের কারণ হচ্ছে।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির চট্টগ্রাম মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আব্দুল হান্নান বাবু বলেন, অনেক রেস্তোরাঁ রয়েছে, যাদের ভালো একটি ওয়াশরুম বা টয়লেট নেই। কোনো রকম একটি জায়গা নিয়ে রাস্তার পাশে রেস্তোরাঁ খুলে বসেছে। আমরা আমাদের সমিতিভুক্ত করার আগে সব কিছু যাছাই-বাছাই করে থাকি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের সাথে কথা না বলে সিটি কর্পোরেশন লাইসেন্স দিয়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন, আমরাও চাই হোটেল রেস্তোরাঁগুলো একটি নিয়ম ও শৃঙ্খলার মধ্যে ভালো মান নিয়ে পরিচালিত হোক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের হাতে সচেতনতার প্রচার ছাড়া কোনো ক্ষমতা নেই।

এসএএস/নচ

এই বিভাগের আরও খবর