chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

ওয়াসার পানি বিক্রি হচ্ছে মিনারেল ওয়াটার নামে !

চট্টলার খবরের অনুসন্ধান

নিজস্ব প্রতিবেদক : চট্টগ্রাম নগরীজুড়ে ওয়াসার সরবরাহ করা পানি ও নলকূপের পানি জারে ভরে মিনারেল ও ড্রিংকিং ওয়াটার নামে বিক্রি হচ্ছে। এভাবে রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের শতাধিক অনুমোদনহীন ড্রিংকিং ওয়াটার ব্যবসায়ী।

চট্টলার খবরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক (মেট) মো. শওকত ওসমান বলেন, অবৈধ ও ভেজাল ড্রিংকিং ওয়াটার জার চেনার সহজ উপায় হচ্ছে বিএসটিআই এর ‘মান’ চিহ্ন দেখে নিতে হবে। অনেকে বিএসটিআই এর জাল সিল ব্যবহার করে থাকে। যদি মান চিহ্ন দেখে পানির জার ক্রয় করে তাহলে ক্রেতারা প্রতারিত হবে না। আর ভেজাল ড্রিংকিং ওয়াটার ক্রেতারা দেখেই অনেক সময় চিনতে পারে।

বিএসটিআই-এর সূত্র মতে, চট্টগ্রাম জেলায় ২৬ টির মতো ড্রিংকিং ওয়াটার কারখানার অনুমোদন আছে (বোতল জাতসহ)। এগুলো হচ্ছে – সিনমিন, আনন্দ, কে-ওয়াটার, ম্যাক, নিউ ওরিয়েন্ট, বাহীব, ইয়েস, মীর, জারা, সতেজ প্রিমিয়ার অ্যাকুয়া হর্স প্রিমিয়ার, কনফিডেন্স, দিশা, ভাইটাল ফ্রেশ, মীর সুপার,দাদা, শীতল, স্টার লাইন সেইফ, নীড, মুসকান, দম, সালসাবিল, মাউন্ট, লিন, ব্লু-এ্যাকোয়া, মামিয়া ও সুবর্ণ।

বিএসটিআইয়ের হিসাব মতে, চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় মিনারেল ওয়াটারের নামে ওয়াসার পানি বিক্রি করে আসছে অনেক প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে, আগ্রাবাদ-ডবলমুরিং এলাকায় সাতটি, হালিশহর-পতেঙ্গা এলাকায় ১২টি, জামালখানের একটি, বাকলিয়া দুইটি, বন্দর এলাকায় তিনটি, পাঁচলাইশ-নাসিরাবাদ এলাকায় চারটি, ফিরিঙ্গীবাজার-সদরঘাট এলাকায় তিনটি, চান্দগাঁও-কালুরঘাট এলাকায় চারটি,  আকবর শাহ এলাকায় তিনটি, পাহাড়তলী-খুলশী এলাকায় চারটি, হাটহাজারী-অক্সিজেন এলাকায় ছয়টি, সীতাকুণ্ড এলাকায় তিনটি এবং আনোয়ারায় একটি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিদিনই নাম সর্বস্ব শতাধিক প্রতিষ্ঠান সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ খাবার দোকানে জারে করে পানি সরবরাহ করছে। প্রকৃত পক্ষে মানহীন এসব এর বেশির ভাগরই বিএসটিআই অনুমোদন নেই। অনুমোদনপ্রাপ্ত ও অনুমোদনহীন এসব প্রতিষ্ঠান নগরীর প্রায় সর্বত্র অস্বাস্থ্যকর পানির জার সরবরাহ করে আসছে। এছাড়া বাসা-বাড়ি, ছাত্রাবাস, হোটেল, কুলিং কর্ণার, টংয়ের দোকান সব জায়গায় এসব অস্বাস্থ্যকর পানি জারের ব্যবহার হচ্ছে দেদার। এসব পানির জারের যথেষ্ট ব্যবহারের ফলে মারাত্মক রকমের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে নগরবাসী। ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিস থেকে শুরু করে মরণঘাতী লিভার সিরোসিসের উৎস মূলত দূষিত পানি। প্রতিনিয়ত নগরীতে অসংখ্য মানুষ জারের দূষিত পানি পান করছে। জনসচেতনতার অভাব এবং প্রশাসনের অবহেলার কারণে একদল অসাধু চক্র অধিক মুনাফার লোভে জারের পানির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

সরেজমিনে নগরীর ডবলমুরিং, মুরাদপুর, পতেঙ্গা, হালিশহরসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত পানি পরিশোধন কারখানা ঘুরে দেখা যায় অধিকাংশই অস্বাস্থ্যকর যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অধিকাংশেরই বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) লাইসেন্স নেই। অনেকের বিএসটিআই’র লাইসেন্স থাকলেও তারা কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ওয়াসার লাইন থেকে পানি সংগ্রহ করে কোন পরিশোধন ছাড়াই বাজারে এই পানি সরবরাহ করছে।

নগরীর বিএসটিআই লাইসেন্সপ্রাপ্ত একটি কারখানা ঘুরে দেখা যায়, আনুমানিক ১০০ বর্গফুটের একটি ল্যাব রয়েছে। ওই ল্যাবে একটি ফার্স্টএইড বক্স এবং কিছু রাসায়নিকের বোতল রয়েছে। যদিও সবগুলো রাসায়নিকের মেয়াদ ২০১৫ সালেই শেষ হয়ে গিয়েছে। কারখানার ভেতরে রয়েছে চারটি ফিল্টার আর একটি পানির রিজার্ভ ট্যাংক। তবে এগুলোর সবই দীর্ঘদিন ধরে বিকল। ল্যাবের ঠিক পেছনের অংশে রয়েছে ওয়াসার লাইনযুক্ত তিনটি কল। এসব কল থেকেই জারে পানি ভরা হচ্ছে। আর ওই পানিই ‘বিশুদ্ধ পানি’ হিসেবে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সনদ নেয়ার জন্য এসব প্রতিষ্ঠান শুটিং সেটের মতো ল্যাব ও টেকনিশিয়ান ভাড়া করে। অনুমোদন পেয়ে যাওয়ার পর ল্যাব, টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে সব সরঞ্জাম ফেরত পাঠিয়ে সরাসরি ওয়াসার পানি বাজারজাত করে। মান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কোনো নজরদারি না থাকায় এভাবে বছরের পর বছর পানি ব্যবসা করে আসছে তারা। অতিরিক্ত মুনাফার আশায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী পানি জারে ভরে বাজারে সরবরাহের ব্যবসা শুরু করেছে। ২০ লিটারের প্রতিটি জারের পাইকারি মূল্য নেয়া হয়ে থাকে ৮ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত।  হাতবদলে এই পানির দাম হয়ে যায় ৬০  টাকা থেকে ৭০ টাকা। আর ক্রেতা পর্যায়ে প্রতি গ্লাস পানির দাম রাখা হচ্ছে এক থেকে দুই টাকা।

তাছাড়া ওইসব পানির জারে সংরক্ষণ করতে বিএসটিআইয়ের নির্দেশনাও অনুসরণ করা হয় না। পানি পরিশোধনের লাইসেন্স প্রদানের আগে বিএসটিআই থেকে কিছু শর্ত যুক্ত করে দেয়া হয়। শর্তগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ থাকে- উৎপাদিত বা প্রক্রিয়াজাত পণ্যের গায়ে বা মোড়কে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা, ওজন, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য, উৎপাদনের তারিখ, ব্যবহারের সময়সীমা এবং বিএসটিআই গুণগতমান চিহ্ন সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। তাছাড়া অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে বছরের যে কোনো সময় পরিদর্শনে যাওয়া হবে বলেও উল্লেখ থাকে।

বিএসটিআই চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. মোস্তাক আহম্মেদ (সিএম) চট্টলার খবরকে বলেন, চট্টগ্রাম বিভাগে ২৬টি  পানি তৈরি কারাখানার লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু ভেজাল পানি তৈরির কারখানা সংখ্যার প্রায় ৫০টি। যার মধ্যে ২৫টির সাথে মামলা পক্রিয়াধীন রয়েছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

তিনি বলেন, তারপরও আমরা নিয়মিত  অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। গত রবিবার সন্ধ্যায়ও ডবলমুরিং এলাকায় একটি অবৈধ কারখানায় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। নিজস্ব ম্যাস্ট্রিস্ট্রেট না থাকাতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে এসব ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হয়।

এসএএস/নচ

এই বিভাগের আরও খবর