chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

নগরীতে এক বছরে ১০ ফেলে যাওয়া শিশু উদ্ধার!

প্রকৃত অভিভাবক শনাক্ত করা কঠিন

মেহেদী হাসান কামরুল : জীবনের রঙ কেমন তা বুঝে ওঠার আগেই যেনো এসব শিশুর কপালে ছাপ পড়ে যায় নিষ্ঠুরতার রেখা। জন্মের আগেই নির্ধারিত হয়ে যায় এদের মৃত্যুর আয়োজন। ঠাঁই হয় রাস্তা, নদর্মা কিংবা ডাস্টবিনে। এক বছরে চট্টগ্রাম নগরীতে এমন নির্মমতার শিকার হয়েছে ১০ নবজাতক শিশু

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীর ১৬টি থানা এলাকায় এ ধরনের ১০ জন শিশুকে পরিত্যক্ত অবস্থায় নালা-নদর্মা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এসব শিশুর প্রকৃত অভিভাবক খুঁজে পাওয়া কঠিন বলে মন্তব্য করেছে পুলিশ।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রামের সিআইডির পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদের সাথে। তিনি চট্টলার খবরকে বলেন, পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে যাওয়া বাচ্চার পরিচয় শনাক্ত করা কষ্টকর। কারণ এসব বাচ্চার অভিভাবককে খুঁজে পাওয়ার কোনো যোগসূত্র থাকে না। সাধারণত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে থানায় মামলা/জিডি হয়। তখন আমরা তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে পরিচয় শনাক্ত করি।

এরপর প্রকৃত অভিভাবকের সাথে প্রয়োজন সাপেক্ষে মৃতদেহের ডিএনএ প্রোফাইল ম্যাচ করা হয়। কিন্তু বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শনাক্তের কোন উপায় থাকে না। তাছাড়া আমাদের প্রতিটি নাগরিকের স্বয়ংক্রিয় ডিএনএ প্রোফাইল বুথ নেই। যেখানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের ডিএনএ প্রোফাইল সংরক্ষণ করা থাকবে।এটা নিশ্চিত করা গেলে অপরাধ কমে যাবে। এসব শিশুদের আভিবাবকও খুজেঁ পাওয়া যাবে। তখন আর কোন শিশুকে লাশ হয়ে ডাস্টবিনে পড়ে থাকতে হবে না।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যান বলছে, গত ৪ বছরে সারাদেশে ডাস্টবিন, জঙ্গল ও রাস্তা থেকে ২১০টি নবজাতক উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪৯ নবজাতক মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বাকিদের জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে বিভিন্ন সংস্থায় হস্তান্তর করা হয়েছে।

২০১৯ সালে ৫৮টি নবজাতক রাস্তা ও নর্দমা থেকে উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে জীবিত ছিল ৪২ জন এবং মৃত ১৬, ২০১৮ সালে ৫৫ জনকে উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে জীবিত ৩৯ জন এবং মৃত ১৬ জন। ২০১৭ সালে উদ্ধারের সংখ্যা ছিল ৪১ জন। এর মধ্যে জীবিত ২৪ আর মৃত ১৭ জন। ২০১৬ সালে উদ্ধার হয় ৩৭ জন। এর মধ্যে ২৮ জীবিত এবং ৯ জন মৃত। সর্বশেষ ২০২০ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া নবজাতকের সংখ্যা ১৯ জন। এর মধ্যে জীবিত ১৬ জন এবং মৃত ৩ জন।

চট্টগ্রাম নগরীতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬টি থানা এলাকায় ১০ জন শিশুকে পরিত্যক্ত অবস্থায় নালা-নদর্মা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। যার ৭ জনই মৃত। এর মধ্যে বন্দর থানা এলাকা থেকে ২টি, পাঁচলাইশ থানা এলাকা থেকে ৩ টি, চাঁন্দগাও থানা এলাকা থেকে ১টি, বাকলিয়া থানা এলাকা থেকে ১টি মৃত শিশু উদ্ধার করা হয়। যাদের বয়স শূন্য থেকে ২৮ দিন।

গত ২৮ নভেম্বর বন্দর থানার নিমতলা এলাকায় শুটকির দোকানের পাশে খালে ফেলে দেয়া কার্টন থেকে দুই নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নিজামউদ্দিন চট্টলার খবরকে জানান, পরিত্যক্ত অবস্থায় খালের পাশে দুটি শিশুর মরদেহ দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেয়। আমার মরদেহ দুটি উদ্ধার করে পোস্টমর্টেম করিয়েছি। কিন্তু এখনও তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাই নি।

এছাড়া তাদের অভিভাবক খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি। তবে এই ধরনের ঘটনায় শিশুদের প্রকৃত অভিভাবক খুঁজে পাওয়া কষ্টের। কারণ তারা লোক-চক্ষুর আড়ালে শিশুদের ফেলে পালিয়ে যায়।

এ ধরনের ঘটনায় অধিকাংশ শিশুদের ভাগ্যে ঘটে নির্মম পরিণতি। এসব শিশু মায়ের কোলে হেসে খেলে বড় হওয়ার কথা থাকলেও অদৃষ্টের লেখন হিসেব তাদের দাফন হয় আঞ্জুমান মুফিদুলে। এখানে যেন নির্মমতার পারদ ঊর্ধ্বগামী।

বেঁচে যাওয়া অধিকাংশ শিশুদের ঠাঁয় হয় সমাজ সেবা অধিদফতরের অধীনে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শিশু নিবাসে।
চট্টগ্রাম সমাজ সেবা অধিদফতরের কর্মকর্তা নুর জাহান চট্টলার খবরকে বলেন, সমাজের এক শ্রেণীর মানুষদের নৈতিক অবক্ষয় বেড়ে যাওয়ায় এ ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে।

এসব শিশুর অভিভাবকরা নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে র্নিমমতার খড়গ চালায় তাদের সদ্যোজাত শিশুদের ওপর। দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে লোকাল থানার জিডির মাধ্যমে আমরা এসব শিশুদের গ্রহণ করি।

আন্তরিকতার শতভাগ দিয়ে তাদের পরিচর্যা করার চেষ্ট করা হলেও সেখানে ঘাটতি থাকে। কারণ একটি শিশু যে পরিবেশ কিংবা পরিচর্যায় বেড়ে উঠার কথা তা পরের অধীনে থেকে শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। পরিবার তো পরিবারই।

নারী ও মানবাধিকার-কর্মীরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই বিয়েবহির্ভূত অনেক ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে নারী-পুরুষ। ফলে এই নবজাতকদের জন্ম যেমন বেড়ে গেছে, তেমনি বেড়ে গেছে জীবন্ত নবজাতককে ফেলে দিয়ে সব দায় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ঘটনা।

এতে করে নবজাতকের জন্মদাতা বাবা-মা হয়তো নিষ্কৃতি পাচ্ছেন, কিন্তু ফেলে দেওয়া নবজাতকের কপালে কী ঘটছে তা জানা নেই কারো।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. ইফেতেখার উদ্দিন চৌধুরী বিষয়টিকে স্পষ্টতর সামাজিক অবক্ষয় বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম প্রেম ভালোবাসার নামে অবাধ মেলোমেশা, লিভ টুগেদার করছে। তাদের অপকর্মের স্মৃতিস্মারক হিসেবে জন্মগ্রহন করছে নবজাতক শিশু।

এসব শিশুদের সামাজিক মর্যাদা কিংবা কোন পরিচয় দিতে পারবে না বলেই তারা তাদের সন্তানকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করে না।

এই সমাজবিজ্ঞানী আরো বলেন, এসব ঘটনা বৃদ্ধির সাথে গুটিকয়েকে বেসরকারি সংস্থা, হাসপাতাল, হাতুড়ে ধাত্রীদের যোগসাজশ রয়েছে। তারা এসব বাঁচ্চা এবোরশন (গর্ভপাত) করে থাকে। ফলে দৃশ্যত যারা এসব অপকর্ম করে তাদের ভেতরে একটা নিশ্চয়তা কাজ করে। তারা ভাবে এবোরশন করে পার পেয়ে যাবে। এবং এটা হচ্ছে।

সামাজিক সচেতনতা ও পারিবারিক শিক্ষা নিশ্চিতের প্রতি জোর দিয়ে ইফেতেখার উদ্দিন চৌধুরী আরো বলেন, পরিবার হতে হবে একটি শিশুর পরিচর্যা কেন্দ্র। তাদের সঠিক যৌন শিক্ষা, পারস্পরিক সর্ম্পক গড়ার ক্ষেত্রে সর্তকতা মেনে চলার বিষয়ে সচেতন করতে হবে।

এএমএস/চখ

এই বিভাগের আরও খবর