chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

কর্ণফুলী পরিণত হয়েছে পলিথিনের ভাগাড়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক : দিন দিন পলিথিনের বর্জ্যে ভরাট হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। খরস্রোতা নদীটি যেনো পলিথিনের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। খাল পাড় নদী তীর থেকে প্রতিদিন পানিতে মিশছে বিপুল পলিথিন। কোন ধরনের তদারকি কিংবা নিয়ন্ত্রণ না থাকায় নদীর পানিতে পলিথিন মেশানো থামছে না।

দখল ও দূষণের কারণে ৮৬৬ মিটার প্রস্থের কর্ণফুলী নদী এখন ৪১০ মিটারে দাঁড়িয়েছে। গত ১৪ বছরে চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এ নদীটির এমন দুরবস্থা হয়েছে। ‘চট্টগ্রাম নদী ও খালরক্ষা আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠন জরিপ শেষে এ তথ্য উপস্থাপন করেছে। চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে ‘কর্ণফুলী দখল জরিপ প্রতিবেদন-২০২০’তুলে ধরেছিল।

ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান চট্টলার খবরকে বলেন, নানা কারণে কর্ণফুলী আজ ধ্বংসের মুখে। এটা দেখার যেনো কেউ নেই। কর্ণফুলীতে আজ ড্রেজিং করলে কাল আবার ভরাট হচ্ছে। মূলত অবৈধ দখলে গড়ে ওঠা শাহ আমানত সেতুর আশপাশে স্থাপনার কারণে ভরাট হচ্ছে কর্ণফুলী একইসঙ্গে পলিথিন বর্জ্যের সাথে গৃহস্থালীর বর্জ্য, কলকারখানার বর্জ্য মিশ্রে পলিথিনগুলো না পচাতে কর্ণফুলী পলিথিনের ভাড়াতে পরিণত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, এই নদীটি রক্ষা করার কথা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কিন্তু তাদের এ ব্যাপারে কোন চিন্তাই নেই। যে কর্ণফুলীতে আগে তিন শতাধিক প্রজাতির মাছ ছিল; সেই কর্ণফুলীতে ৯০ প্রজাতির মাছও মিলছে না।

সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভাটার সময় খাল থেকে পলিথিন সহ নানা বর্জ্য মিশে যায় নদীতে। আবার জোয়ারের সময় কর্ণফুলীর বর্জ্য মিশে যায় নগরীর কয়েকটি খালে। এতে খালগুলো ভরাট হওয়ার মত অবস্থা। বর্জ্যেরে কারণে নদীর বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে নাব্যতা সঙ্কট। এভাবে বিরামহীন বর্জ্য পড়তে থাকলে এক সময় কর্ণফুলী নদীর অস্বিস্থ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কর্ণফুলী নদীর এক সময় ছিল ভরা যৌবন। এক দশক আগেও নদীর নব্যতা সঙ্কট তেমন ছিলনা। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। নদীর সব পয়েন্টেই পানির গভীরতা কমছে। তদারকি না থাকায় পলিথিন সহ নানা ধরনের বর্জ্য পড়ছে নদীতে। ড্রেজিং করতে গেলেই পলিথিনের আস্তর বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। এতে নদীর নব্যতা সঙ্কট কাটাতে ড্রেজিং করার কাজও ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, নগরীর চাক্তাই এলাকায় খাল থেকে বেশি বর্জ্য পড়ছে নদীতে। ভাটার সময়ে খাল থেকে আসা দূষিত পানি কর্ণফুলীতে গিয়ে মিশছে। রাসায়নিক বর্জ্যের কারণে খালের পানির রঙ পরিবর্তন হয় প্রায় সময়। খালের মুখে পানির স্বাভাবিক রং পরিবর্তন হয়ে কালো রূপ ধারণ করে প্রায় সময়। খালের পানির সাথে নদীতে অব্যাহতভাবে আসে পলিথিনসহ নানা আবর্জনা। পরে তা প্রবেশ করে কর্ণফুলীতে।
বর্তমানে নগরীতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চলছে। বেশকিছু খাল খনন করা হচ্ছে। চাক্তাই খালের সামনের অংশও খনন করা হয়েছে। কিন্তু খালের উজান থেকে আসা বর্জ্য ও পলিথিনের কারণে খালের মুখ ফের ভরাট হয়ে সরু হয়ে যাচ্ছে। শুধু চাক্তাই খাল নয়, নগরীর মাঝ বরাবর ও আশপাশে বয়ে বহু খাল মিশে গেছে কর্ণফুলী নদীতে। সেই সব খাল থেকেও সমানে পলিথিন সহ নানা বর্জ্য মিশছে নদীতে।

চাক্তাই খাল এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, খালের দু’পাশেই রয়েছে অসংখ্য বসত ঘর। বস্তির সংখ্যাও অনেক। এসব এলাকার বাসিন্দারা গৃহস্থালী ময়লা-আবর্জনা সব সময় ফেলে খালে। ভাটার টানে এসব আবর্জনা নদীতে গিয়ে পড়ছে। পলিথিন ও আবর্জনার কারণে পানির রাতে বাধাগ্রস্ত হয়ে বিভিন্নস্থানে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীর পাড়ের শৌচাগারের মলমূত্র ছাড়াও পলিথিন এসে মিশছে নদীতে। দূষণের কারণে জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়ছে। নদী থেকে হারিয়ে গেছে কমপক্ষে ৩০ প্রজাতির মাছ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কর্ণফুলীকে ঘিরে ১৬ টি শিল্পজোনে ছোট বড় ৮শ’ শিল্প কারখানা রয়েছে। চামড়ার আড়ত, টেক্সটাইল কারখানা, ক্যামিকেল কারখানা, মৎস্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা, সাবান কারখানা, স্টিল মিল, কর্ণফুলী পেপার মিল (কেপিএম) সহ কয়েকটি ব্যক্তি মালিকানাধীন পেপার মিল, চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি (সিইউএফএল), ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) কারখানা, কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো), কোমল পানীয় কারখানা, পেইন্ট (রং) কারখানা, সিমেন্ট কারখানা সহ প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ কারখানার বর্জ্য সরাসরি কর্ণফুলীর পানি দূষিত করছে। এসব কারখানার প্রায় সবই তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (ইটিপি) ব্যবহার করে না।
বিশেষ করে নদীতে কর্ণফুলী পেপার মিল (কেপিএম), চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি (সিইউএফএল), চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ সিস্টেমের বর্জ্য সবচেয়ে বেশি দূষণের জন্য দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নগরীর ৭০ হাজার স্যানিটারি পায়খানা, ৪০ হাজার খোলা পায়খানা ও ৬শ’ কসাইখানা, একহাজারের বেশি বস্তির প্রতিদিন গিয়ে পড়ছে নদীতে। এতে কর্ণফুলীর দূষণের মাত্রাও বাড়ছে। অন্যদিকে জেলার বিভিন্ন আবাদি জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের ২৫ শতাংশ ৩০টি শাখা খালের মাধ্যমে কর্ণফুলীতে চলে আসে। সিটি কর্পোরেশনের সলিড ডাম্পিং স্টেশন থেকে বর্জ্যরে নির্যাস বর্ষা মৌসুমে কর্ণফুলী নদীতে চলে আসে। তাছাড়া কর্ণফুলী নদীতে চলাচলকারী ১ হাজার ২শ’ ছোট লাইটার জাহাজ, শতাধিক অয়েল ট্যাংকার, ইঞ্জিন চালিত সাড়ে ৩ হাজার নৌকার বর্জ্য প্রতিনিয়ত কর্ণফুলীর পানির সাথে মিশছে। নদীতে চলাচলরত নৌযানের পোড়া তেল এবং দুই তীরের বিশাল এলাকার প্রায় ৬০ লাখ অধিবাসীর গৃহস্থালির বর্জ্যও গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলীতে।

এসএএস/নচ

এই বিভাগের আরও খবর