chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

মোগল আমলের শ্রীপুর বুড়া মসজিদে আসছে নতুন স্থাপত্য শৈলী

নিজস্ব প্রতিবেদক : চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর খরণদ্বীপ ইউনিয়নে অবস্থিত মোগল আমলে নির্মিত ঐতিহ্যবাহী শ্রীপুর বুড়া মসজিদের সংস্কারে হাত দিচ্ছে প্রশাসন। নতুন আঙ্গিকে মসজিদ পুন:নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে মসজিদটিতে ছোঁয়া লাগবে দৃষ্টিনন্দন আধুনিক ও নতুন স্থাপত্য শৈলী।

মসজিদের বর্তমান স্থাপত্য শৈলি

এ মসজিদে দেশ-বিদেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সমাগম ঘটে বরকত, ফজিলত ও তাৎপর্যপূর্ণের আশায়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সারাদেশের মানুষের কাছে পুণ্যময় তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত এ বুড়া মসজিদ। মসজিদটি ঠিক কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সঠিক দিনক্ষণ জানা যায়নি। তবে ৩০০ বছর আগে মোগল আমলের শেষ দিকে এটি নির্মিত হয় বলে অনেকেরই ধারণা। কয়েক শতাব্দী ধরে এই মসজিদের সংস্কার কাজ না হলেও বর্তমানে মসজিদটি সংস্কারে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যার ফলে বদলে যাবে শতবছরের পুরনো মসজিদটি।

উত্তরসূরিদের পক্ষে নুরুন্নবী চৌধুরী বলেন, বর্তমানে মসজিদের অফিসিয়াল মোতাওয়ালি বোয়ালখালী ইউএনও আছিয়া খাতুন, এসিল্যান্ড মোজ্জাম্মেল হক চৌধুরী, স্থানীয় চেয়ারম্যান মো. মোকারমসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে ঐতিহাসিক এ মসজিদের উন্নয়নে মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আছিয়া খাতুন বলেন, বোয়ালখালীতে কাজ করতে গিয়ে জানার সুযোগ হয় উপজেলার শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী শ্রীপুর বুড়া মসজিদ সম্পর্কে। ইউএনও হিসেবে অফিসিয়াল মোতাওয়ালি দায়িত্বে থাকায় সরেজমিন জানার পরিধি কিছুটা বিস্তৃত হয়। অপার বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব রকমের মানুষের কাছে মসজিদটি একধরণের তীর্থভূমি হিসেবে সমাদৃত।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, প্রতি জুমাবার দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মুসল্লী জুমার নামাজ আদায় করতে ছুটে আসেন এ মসজিদে। বিভিন্ন নিয়ত করে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ এখানে ছুটে আসেন। কেউ মোমবাতি জালিয়ে, কেউ চুন লাগিয়ে, কেউ রশি বেঁধে, কেউ টাকা-পয়সা দান করে, কেউবা পশুপাখির সদকা দিয়ে মানত করেন। মনোকামনা পূরণের জন্য এ মসজিদে মানত করলে তাৎক্ষনিক ফল পাওয়া যায় বলে অনেকেই মনে করেন। মসজিদটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও বেশ তাৎপর্যময়।

জানা যায়, মোঘল আমলে শেখ নাছির উদ্দিন নামক একজন আলেম ভারতের গৌড় থেকে অমুসলিম অধ্যুষিত এ এলাকায় এসে দ্বীন প্রচারের মাধ্যমে মানুষজনকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। প্রায় ৩শত বছর পূর্বে মোঘল আমলের শেষ দিকে তাঁর পৌত্র ওয়াসিন চৌধুরী এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন বলে জনশ্রুতি আছে। ঝোঁপ-ঝাড়ের মাঝে শন পাতার বেড়া ও ছাউনি দিয়ে তৈরি এ মসজিদটিতে গায়েবী আজান শোনা যেত। বন্য পশুপাখিরাও এ মসজিদে ইবাদত করত বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কালের সাক্ষী হয়ে বিভিন্ন সময় সংস্কার ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে মসজিদটি বর্তমান পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ মসজিদটির পরিচালনায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের অবহেলা ও অদক্ষতায় বহু বৎসর যাবত মসজিদটিতে অবকাঠামোগত কোন উন্নয়ন করা হয়নি। সংস্কার ও পরিচর্যার অভাবে বর্তমান ভবনটি অত্যন্ত জীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে, বেশ কয়েক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে, শুক্রবারে জুমার  নামাজে মুসল্লিদের স্থান সঙ্কুলান কঠিন হয়ে পড়েছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, ১৮৮৬ সালে বেড়া ও ছনের ছাউনি ঘর প্রবল ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যায়। ভাঙা অবস্থায় জোড়া তালি দিয়ে আরো ২০-২৫ বছর চলে এ মসজিদের কার্যক্রম। পরে স্থানীয় লোকজন মাটির দেয়াল তুলে পুনঃনির্মাণ করেন এ মসজিদ। এভাবে ৪-৫ বার নির্মাণ করা হয়। প্রায় ১০০ বছর পূর্বে মসজিদের কিয়দংশ পাকাকরণ করা হয়। ১৯৪০ সালে মসজিদের পুরাতন ভিত্তি ভেঙে নতুন করে ছাদ জমিয়ে পাকাকরণ করা হয়। এই ইমারত এখনও পর্যন্ত মসজিদের মধ্যখানে বহমান আছে। ১৯৭৪ সালে ৫-৬’শ জন মুসল্লি নামায আদায় করার ব্যবস্থা করে মসজিদ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়। ১৯৮৬ সালের দিকে দ্বিতীয় তলায় উন্নীত করা হয় এ মসজিদ। ১৯৭৫ সালের দিকে এ মসজিদের পাকা ভবনের গেইট নির্মিত হয়। বলা বাহুল্য, এই মসজিদে প্রতি শুক্রবার জু’মা নামাজে এলাকার মুসল্লি ছাড়া আশেপাশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও মুসল্লিরা এসে নামাজ আদায় করেন। এখনো এ রেওয়াজ চালু আছে।

উল্লেখ্য, ২০০০ সালে ওয়াকিফ এস্টেট হিসেবে ঈশই তালিকাভুক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে মোতয়াল্লীসহ কতিপয় ব্যক্তিবর্গের যোগসাজশে মসজিদের দানবাক্সের টাকা আত্মসাৎ হয়। ২০১৪ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার খন্দকার নূরুল হক এর উদ্যোগে এ দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং  তৎপ্রেক্ষিতে ওয়াকফ প্রশাসন কর্তৃক উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে মসজিদের অফিসিয়াল মোতাওয়ালি নিয়োগ করা হয়।

ইউএনও আছিয়া খাতুন বলেন, প্রশাসনিক কাজে যতবারই মসজিদটি পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছে আমি পবিত্র এ স্থানটি সংস্কার করার তাগিদ অনুভব করেছি তীব্রভাবে। স্বপ্ন দেখেছি যদি সুন্দর একটি পরিকল্পনা করে অনন্য স্থাপত্যশৈলী দিয়ে আধুনিক ল্যান্ডস্কেপসহ মসজিদটি পুন:নির্মাণ করা হয়; তবে তা শুধু চট্টগ্রাম নয় সারাদেশের মানুষের জন্য আকর্ষণীয় পুণ্যভূমি হিসেবে খ্যাতি লাভ করবে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হিসেবে দেশের স্বনামধন্য একটি ডিজাইন ফার্মের মাধ্যমে আমাদের আবেগ ও ভাবনার প্রতিফলনে পুরো মসজিদ কমপ্লেক্সের একটা মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। যেখানে দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক স্থাপত্য নকশায় সুউচ্চ মিনারসহ চারতলা মসজিদ ভবন ছাড়াও রয়েছে সুপ্রশস্ত প্রবেশদ্বার, ঈদগাহ, কবরস্থান, এতিমখানা ও মাদ্রাসা সম্বলিত একাডেমিক ভবন, বৃহৎ পরিসরে ওযুখানা, মহিলা ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য পৃথক এবাদতখানা, রান্নাঘর, ডাইনিং হল, কার পার্কিং, সর্বোপরি মসজিদ সংলগ্ন পুকুরটি সংস্কার করে সুদৃশ্য পুকুর ঘাট, ওয়াক ওয়েসহ অনন্য সাধারণ ল্যান্ডস্কেপ। মসজিদটি নির্মাণে খরচ হবে প্রায় ২৫ কোটি টাকা।

এসএস/নচ

এই বিভাগের আরও খবর