chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

নগরীতে ছয় মাসে ছুরিকাঘাতে ১৫ খুন !

অপরাধ নিয়ন্ত্রণ শূন্যের কোটায়

মেহেদী হাসান কামরুল: ব্যস্ত এই নগরীতে প্রতিনিয়ত ঘটছে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, অপহরণসহ নানা অপরাধ। তবে এসব অপরাধের সাথে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ছুরিকাঘাতের ঘটনা। গত ছয় মাসে নগরীর ১৬ থানায় ছুরিকাঘাতে অন্তত ১৫টি  খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। কিন্তু ছুরিকাঘাত জনিত এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ অনেকটা শূন্যের কোটায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নগরের ১৬ থানার বিভিন্ন এলাকায় ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৫০ টি। আর ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছেন অনন্ত ১৫ জন। এগুলো থানা ও মেডিকেল রেকর্ড সূত্রে পাওয়া তথ্য। এর বাইরে আরো অনেক ঘটনা আছে যা থানার টেবিল পর্যন্ত গড়ায় না। যায় না মেডিকেলের রেজিস্টার পর্যন্ত। বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় প্রকৃত তথ্য লুকিয়ে চিকিৎসা কাজ সারা হয়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় গত ৬ মাসে ছুরিকাঘাতের যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার মূলে রযেছে পারস্পরিক কথা কাটাকাটি। সামান্য কথা কাটাকাটি থেকে খুন হয়েছেন চারজন।

এর মধ্যে সবচেয়ে আলোড়ন ফেলেছে নগরীর আকবর শাহে ঘটে যাওয়া নৃশংস খুনের ঘটনা। চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর রাতে বিজয়নগর এলাকায় সামান্য কথাকাটাটির জের ধরে রনি ওরফে মালু নামের ২১ বছর বয়সী এক যুবককে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। ওই ঘটনায় পুলিশের করা সুরতহাল প্রতিবেদনে মালুর শরীরে ২২টি ছুরিকাঘাতের ক্ষত চিহ্ন পাওয়ার কথা জানায়। খুনের সাথে জড়িত থাকায় পুলিশ তাৎক্ষণিক শহিদুল ইসলাম নামের এক যুবককে গ্রেফতার করে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আকবরশাহ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো.আরশাদুল চট্টলার খবরকে বলেন, ঘটনার কিছুদিন আগে রনির সাথে শহিদুলের ভাইয়ের কথা কাটাকাটি হয়। যা এক পর্যায়ে মারামারি পর্যন্ত গড়ায়। পরবর্তীতে বিষয়টি পারিবারিকভাবে মীমাংসা হওয়ার কথা থাকলেও তা আর হয়নি। ঘটনার দিন রাতে রনিকে একা পেয়ে ভাইয়ের সাথে বেয়াদবির প্রতিশোধ নিতেই তার সারা শরীরে ২২ টি ছুরিকাঘাত করে অভিযুক্ত আসামি শহীদুল।

মামলাটির বর্তমান অবস্থা সর্ম্পকে এসআই আরশাদুল আরো জানান, পোস্টমর্টেম রির্পোট হাতে পেয়েছি। মামলার চার্জশিটও প্রস্তুত। আশা করছি খুব শীঘ্রই আদালতে সাবমিট করতে পারবো। বিচার কাজও দ্রুত শুরু হয়ে যাবে।

গত ৩ আগস্ট খুলশী থানার জালালাবাদ এলাকার একটি পাহাড়ে উপর্যুপরি ছুরির আঘাতের খুন হন স্কুলছাত্র মো. রাসেল (১৩)। এ ঘটনায় নিহত রাসেলের বন্ধু হাসানুল হক হাসানকে গ্রেফতার করে খুলশী থানা পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে রাসেলকে ছুরিকাঘাত করে খুন করে বলে জানায় হাসান।

এছাড়া গত ১৫ অক্টোবর হালিশহরের মহেশখাল থেকে মিজানুর রহমান লিটন নামে এক যুবকের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে হালিশহর থানা পুলিশ। ওই ঘটনায় ২০ অক্টোবর মো. ফয়সাল নামের এক কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে কথা কাটাকাটি থেকে ছুরিকাঘাত করে লিটনকে খুন করা কথা স্বীকার করে ফয়সাল।

চলতি মাসের ৬ ডিসেম্বর রাতে পাহাড়তলী থানার দক্ষিণ কাট্টলী এলাকার জেলে পাড়ায় মোহাম্মদ মাহবুব নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরদিন পুলিশ অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পাহাড়তলী থানার ওসি (তদন্ত) রাশেদুল হক চট্টলার খবরকে বলেন, মাদক কেনার ১০ টাকা চাওয়া এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিতে আড্ডাস্থলে বসা নিয়ে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বাকবিতণ্ডায় মাহবুববকে বাম পাঁজরে ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মাহবুব মারা যান।

এগুলো ছাড়াও চান্দগাঁওয়ে মা-ছেলে কুপিয়ে হত্যা, ডবলমুরিংয়ে গাড়ি চালক আইয়ুব আলী হত্যা, বন্দরের আনন্দবাজারের সাগর পাড়ে ইব্রাহিম খলিলকে গলাকেটে হত্যার মত ঘটনা আবাক করে নগরবাসীকে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর চট্টলার খবরকে বলেন, ছুরিকাঘাতের ঘটনাগুলো সবসময় প্ল্যান করে ঘটানো হয় না। এগুলো সবগুলোই ইনডিভিজুয়াল কেইস (আলাদা এবং স্বতন্ত্র অপরাধ)। এগুলোকে বিশেষ কোনো অপরাধের সাথে সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ নেই। ছুরিকাঘাতের ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছেন তাদের বিষয়টাকে আমরা হত্যা মামলা হিসেবে রেকর্ড করি।

ছুরিকাঘাতসহ সবধরনের অপরাধ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে পুলিশ সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছে জানিয়ে কমিশনার আরো বলেন পুলিশের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। দু’জন মানুষ পাশাপাশি বসে আছে। হঠাৎ করে কেউ একজন ছুরি মেরে দিলো। এটা তো পুলিশ রোধ করতে পারবে না। তাছাড়া সিএমপিতে যতগুলো ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটেছে সবগুলো পুলিশ সতর্কতার সাথে তদন্ত করছে। সঠিক তদন্ত নিশ্চিতের পাশাপাশি অপরাধ সংগঠিত করে কেউ পার পাবে না।

এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর.ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী চট্টলার খবরকে বলেন, ছুরিকাঘাতের সাথে কিশোর অপরাধীদের সম্পৃক্ততা বেশি। সমাজের এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তিরা নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্যে হাসিল করতে ছোট ছোট বাচ্চাদের ব্যবহার করে। অপরাধ করতে করতে একসময় তারা মাদকের সাথে জড়িয়ে যায়। আর যখন একজন ব্যক্তি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তখন তার মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকারিতা হারায়। ফলে দেখা যায় বন্ধুকে ছুরি মারছে, বাবা-মা’কে ছুরি মারছে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে।

এসব কোমলমতি শিশুদের যথাযথ কাউন্সেলিং বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে তিনি আরো জানান, যারা শিশুদের অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন তাদের পরিশুদ্ধ হতে হবে। না হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালনা করা কষ্টকর হয় যাবে। সমাজে বিশৃঙ্খলা, খুন-খারাবি, ছুরিকাঘাতের ঘটনা বাড়তেই থাকবে।

নচ/চখ

 

এই বিভাগের আরও খবর