chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ জীবনের গতি পাল্টে দেয়-রুস্তম আলী বীর প্রতীক

বাঙালিদের টিটকারি করে বলতো-‘বাঙ্গাল কা বাচ্চা,মুজিব কা বাচ্চা”

চট্টলার চোখে : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার উত্তর ঘোড়ামারা গ্রামের মোখলেসুর রহমান ও সাঈদা খাতুনের চার ছেলে-মেয়ের দ্বিতীয় সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রুস্তম আলী (বীর প্রতীক)।

১৯৭১ সালে ভয়াল সেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বুকে আখড়ে ধরে এখনো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিতে চোখ ভাসায় এ বীর যোদ্ধা।

তার স্মৃতি বিজরিত মুক্তিযুদ্ধের কিছু ইতিহাস বিজয়ের মাসে প্রিয় পাঠকদের কাছে তুলে ধরতে কথা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রুস্তম আলীর সাথে।

বাড়ির উঠোনে বসে চায়ের আড্ডার শুরুতেই বিজয়ের মাসের স্বাধীন বাংলাদেশ আর স্বাধীনতা লাভের আগে পূর্বপাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রুস্তম আলী।

তিনি বলেন, পাকিস্তান আমল থেকেই সমুদ্রের পাড়ে বাড়ি আমার। তখন থেকেই বন্যা, সাইক্লোন আর জলোচ্ছ্বাসের মতো বড় দুর্যোগ দেখতে দেখতে বড় হয়েছি।

জলোচ্ছ্বাসে শত শত মানুষের লাশ ভেসে যেতে দেখেছি, গাছের ওপর থেকেও নামিয়েছি অনেকের লাশ। এসব দেখতে দেখতে চোখের জলও যেন শুকিয়ে গেছে।বীর মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলী বীর প্রতিক

বীর এ যেদ্ধা বলেন, সমুদ্র গিলে খেয়েছে পূর্বপুরুষদের জমিজমার সিংহভাগ অংশ। অতচ তখন যদি সমুদ্র পাড়ে একটি বাঁধের ব্যবস্থা করতো আজ হয়তো কোটিপতিদের একজন আমিও হতাম।

কিন্তু তারা এটা করেনি কারণ পাকিস্তান সরকার সবসময় চাইতো আমরা সমুদ্রে ভেসে যায়,মরে যায়। তবে বঙ্গবন্ধু জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান তা হতে দেননি। সমুদ্র গর্ভে কিছু সম্পত্তি ভেসে গেলেও আমাদের পরিবারের সবাই এখনো প্রাণে বেঁচে আছে তার কল্যাণে।

তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর নের্তৃত্বে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমার এলাকায় কল্পনাতীত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। আমি আজ একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গর্ববোধ করছি। আমি স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক।

শত বাধা পেরিয়ে দেশটা একদিন উন্নত বাংলাদেশ হবে এমনটাই বিশ্বাস বীর প্রতীক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলীর। মনে প্রাণে তাঁর বিশ্বাস লাখো শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে দেশ কখনও পথ হারাবে না। পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে এই যোদ্ধা এখনো স্বপ্নের বীজ বোনেন।

বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারকে তিনি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, দুর্নীতি যারা করছে, যেসব ব্যাক্তি বা সংগঠন সরকারের নাম ভাঙ্গিয়ে দেশের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে তারা যত বড় রাঘব বোয়ালই হোক না কেন এবং যে দলেরই হোক না কেন সময় থাকতে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

তাছাড়া এ স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মকে যেন কেউ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে বঙ্গবন্ধু কণ্যার প্রতি তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন।বীর মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলী বীর প্রতিক

তার সাথে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় ঘোড়ামারা প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেখার হাতেখড়ি হলেও রাজাপুর প্রাইমারি স্কুল থেকেই তিনি পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছেন। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে মেট্রিক পাস করেন কুমিরা হাই স্কুল থেকে এবং ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন চিটাগাং কলেজে।

বীর প্রতিক রুস্তম আলী বলেন,‘তখন চট্টগ্রাম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফাস্ট ইয়ারের ছাত্র। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটেই থাকতাম। এয়ারফোর্সের রিক্রুটিং সেন্টার ছিল মেহেদিবাগে। লিখিত পরীক্ষায় টিকতেই ভাইবা হয়। সেটাতেও পাস করলাম।

অতঃপর বেসিক ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা ট্রেনিং সেন্টারে। ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বিমানবাহিনীতে যোগ দিই। বেসিক ট্রেনিংয়ের পরই ট্রেড বাছাই চলে।

ট্রেডভিত্তিক ট্রেনিংয়ে ওরা আমাকে পাঠিয়ে দেয় করাচি করংগিক্রিকে। অতঃপর পোস্টিং হয় সারগোদায়। সবচেয়ে বড় বিমানঘাঁটি ছিল ওটা। ছিলাম এলএসসিতে।

ফ্লাইট লাইনে কাজ করতাম। কাজ করেছি সবচেয়ে বড় যুদ্ধ বিমানেও। বিমানে রকেট, বোম, মিশাইল, মেশিন গান প্রভৃতি ফিট করাই ছিল কাজ। পদ ছিল এলএসিএম। সার্ভিস নম্বর ছিল ৮৩১৮৯।’

১৯৭০ সালের ডিসেম্বর দেশ যখন উত্তাল। সারাদেশে যখন মিছিল মিটিং ও অসহযোগ আন্দোলন চলছে। ঠিক এর কয়েক মাস আগে দেশে একবার বড় বন্যা হয়েছিল। তখন আমি দু মাসের ছুটি নিয়ে ঢাকায় নেমে সোজা চলে যাই গ্রামে।

বাড়িতে এসে শুনি পাকিস্থানি পতাকা পুড়িয়ে দিয়েছে কুমিরা স্কুলের ছাত্ররা। এরপর থেকে মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন ও টেনশন ভর করলে আরো পনের দিন ছুটি বাড়িয়ে গ্রামের বাড়িতেই থেকে যায়। দেখতে দেখতে ছুটি শেষ হলে পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে অশান্ত মন নিয়েই ঢাকার তেজগাঁও এয়ারপোর্টে পৌছালাম।

পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়ার জন্য এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করি। পরক্ষনেই এয়ারপোর্টের বাইরে এসে লোকমুখে যখন রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেবেন শুনি তখন মন আর পাকিস্তানে যেতে সাই দেয়নি। থেকে গেলাম এবং পরদিন সাধারণ পোশাকেই রেসকোর্স ময়দানে চলে যাই।

সেখানে লাঠি হাতে হাজার হাজার মানুষের সাথে আমি বঙ্গবন্ধুর নামে শ্লোগান ধরি। দুপুরের পর শেখ সাহেব উঠলেন মঞ্চে। সবার মুখে মুখে একদফা। বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

এরপর আর কোন ঘোষণার প্রয়োজন হয়নি। বঙ্গবন্ধু তখন একমাত্র নেতা। পৃথিবীর ইতিহাসে নেতা না থাকলে কোন জাতির পক্ষে যুদ্ধ জয় করা সম্ভব নয়।

মুক্তিযুদ্ধে প্রতিটি অপারেশনে ওই ভাষণই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা। তার ওই ভাষণই জীবনের গতি পাল্টে দেয়।”

এরপর দেশের শত্রুদের কাছে ফিরে না গিয়ে কাউকে না জানিয়ে কমলাপুর থেকে ট্রেন ধরে ফের গ্রামে এসে আত্মগোপনে থাকি।

সীতাকুণ্ডের কুমিরায় প্রতিরোধ যুদ্ধসহ ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম এয়ার ফাইটে অংশ নিয়েছেন বললেন বীর প্রতিক রুস্তম আলী।

সেদিনের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি যা বললেন, সেদিনকার রাত তখন বারটা। প্রথম বিমান যুদ্ধের জন্য সবাই প্রস্তুত। বিমান বা অর্টারে ফ্লাই করার আগে জানানো হয় চট্টগ্রাম অ্যাটাক করতে হবে।

চারজন। ফ্লাইট লেফটেনেন্ট শামসুল আলম পাইলট, কো-পাইলট ক্যাপ্টেন আক্রাম, এয়ার গানার রুস্তম আলী আর সার্জেন্ট হক বোম ড্রপিংয়ে। এর আগে রাত দশটায় কৈলাশহর থেকে ইন্ডিয়ান বর্ডার দিয়ে বিমানটি উড়ে যায়। যাতে পাকিস্তানি রাডারে তা ক্যাচ না করে।

চিটাগাং দিয়ে ঢুকতেই সীতাকুণ্ড, পরে পাহাড়। যখন পাহাড় ক্রস করছিলাম তখন সামসুল আলম সাহেব বলেন- ‘রুস্তম, নাউ উই আর ক্রসিং সীতাকুণ্ড হিল।‘ আমি বলি- ‘ইয়েস স্যার। দিস ইজ মাই নেটিভ থানা। অতঃপর আমরা বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করি, একেবারে নিচে নেমে।”

“অনেক নিচ দিয়ে ফ্লাই করছি আমরা। চাঁদের আলো ছিল। নিচে সব দেখা যাচ্ছে। আকাশে এক-দুইটা চক্কর দিয়েই আসি চিটাগাং, ইস্ট পাকিস্তান ওয়েল রিফাইনারিতে। ওটা ধ্বংস করাই ছিল টার্গেট। ওটা উড়িয়ে দিতে হবে।”

“প্রথম বারেই রকেট, মেশিন গান, বোম একসাথে শুরু করলাম। আমি মেশিন গানের গুলি আর বোম ড্রপ করে সার্জেন্ট হক। প্রথম অ্যাটাকেই দাউ দাউ করে আগুন লেগে গেল। বিকট আওয়াজ হচ্ছিল। শামসুল আলম সাহেব বলেন- ‘সুড আই টেক এনাদার অ্যাটেম্ট। আমি বলি- ‘নো স্যার, উই আর সাকসেসফুল।’

পাকিস্তানিরা প্রথম মনে করেছে এগুলো তাদের বিমান। তাই ওরা প্রথমে কিছু করেনি। ধ্বংস আর আগুন দেখে ওরা পাগল হয়ে যায়। চট্টগ্রাম তখন ওদের নেভালের দুর্গ।

নেভি আর আর্মিরা অ্যান্টি এয়ার ক্রাফ্ট গান দিয়ে গুলি করতে থাকে। একটা লাগলেই আমরা শেষ হয়ে যেতাম। মইরতু আই বাছি গেই আরা।”

তিনি বলেন, যুদ্ধ তো আমরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকেই শুরু করেছিলাম। ট্রেনিং নিয়ে তখন করাচিতে আছি। বরিশালের একটা ছেলে ছিল। নাম জাহাঙ্গীর। ওর সাথে কথা কাটাকাটি হয় শাহজাহান নামের এক পাঞ্জাবির। দেশ নিয়ে কথা উঠতেই উত্তেজিত হয় জাহাঙ্গীর। ওরা দুজন তুমুল মারপিট করে।

পাঞ্জাবিদের আচরণ তখন ভাল ছিল না। দশ বারজন আমরা একসাথে থাকতাম। বাঙালিদের ওরা টিটকারি করে বলতো-‘বাঙ্গাল কা বাচ্চা। মুজিব কা বাচ্চা।’ আমরাও রেগে বাংলা ভাষায় খাস গালি দিতাম। ওরা কিছুই বুঝত না। শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে হা করে থাকত। প্রত্যেক জায়গায় চলত এমন গালাগালি।

এক সময় নিয়ম করা হয়। মাদার ল্যাঙ্গুয়েজে কেউ কথা বলতে পারবে না। আমরা তখন ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা গালি দেওয়া শুরু করি।”

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্থানি সেনারা যখন ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে ঠিক তখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ম্যাসাকার করার টার্গেট নিয়ে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের দিকে সেনাদের একটা কনভয় মার্চ আসতে থাকে।

এটি ফেনী, মিরেরসরাই পাড় হয়েছে শুনে কিছু অফিসার ও অস্ত্রসহ সৈন্য নিয়ে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভুঁইয়া পাহাড়ের পথ পেরিয়ে অবস্থান নেয় কুমিরায়। তাদের সঙ্গে ছিল মেশিনগান, এলএমজি, রাইফেল প্রভৃতি।

ঠিক ওই সময়ে এমভি সোয়াত নামক একটি জাহাজে করে পাকিস্তান থেকে এক শিপ অস্ত্র চট্টগ্রাম আনা হয়।

বাঙ্গালিদের মারার জন্য আনা অস্ত্রগুলো শিপ থেকে আনলোড করে ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পথে ইপিআরদের একটা গ্রুপ সোয়াতের দুই ট্রাক অস্ত্র দখল করে নেয়। পরে সেগুলো সীতাকুণ্ডের কুমিরা স্কুলের পেছনের খালেই আনলোড করা হয়।

স্থানীয় জনগনসহ এদের সঙ্গেই প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন রুস্তম আলী। কুমিরায় পাকিস্তানি সেনাদের তিনদিন ঠেকিয়ে রেখেছিল বীর প্রতিক রুস্তম আলী ও তার টিমের সদস্যরা।

রাজীব সেন প্রিন্স/চখ

এই বিভাগের আরও খবর