chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

হয়ে উঠুন উদ্যোক্তা

নিলা চাকমা : ১. প্রবীণ চাকমা। অন্যসব ছেলেদের মতো বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে ২০১৪ সালে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে জিপিএ ৪.৪৫ নিয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর আরেক ধাপ স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে চট্টগ্রাম শহরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এনআইটি)কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে ইলেকট্রনিক ডিপার্টমেন্ট এ ৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা শেষ করেন। এরপর ১ বছর ইন্টার্নি করে হয়ে যান ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। এরপর সার্টিফিকেট নিয়ে বিদায় নেন এনআইটি থেকে। 

এরপর সার্টিফিকেট ভরা ফাইল নিয়ে চাকরির সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে কেটে গেল আরো একটি বছর।
কিন্ত কোথাও মিললো না চাকরি নামের সোনার হরিণ।
শেষে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট এ যোগদান করেন প্রবীণ। বছর দুয়েক কাটলো ভালোই। তারপর বিশ্বজুড়ে হানা দিলো করোনা মহামারী। করোনার জেরে চাকরিটাই চলে গেল প্রবীণের।
শুরু হল বেকারত্ব। পরিবারের চাপ, বন্ধুমহলের খোটা। সামাজিক বিড়ম্বনা থেকে বাঁচার জন্য যে কোনো একটা চাকরির সন্ধানে মরিয়া হয়ে ওঠেন প্রবীণ। অবশেষে একটা বেসরকারি কোম্পানিতে নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরি জুটলো তার কপালে। উপায় না দেখে সেই চাকরিতেই নাম লেখালেন প্রবীণ।
তবে এই চাকরিটাও বেশিদিন করা হয়নি তার। একদিন এক বন্ধু তাকে ডিউটিরত অবস্থায় দেখে ফেলে। তাকে নিয়ে শুরু হয় কানাঘুষা। উপহাস করেও কথা বলতে থাকে বন্ধুরা।
এসব সহ্য করতে না পেরে একদিন গার্ডের চাকরি ছেড়ে রাঙ্গামাটি চলে যান প্রবীণ। আর এখন পুরোপুরি বেকার তিনি। অপেক্ষায় আছেন কবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

২. জুম্ববি চাকমা(ছদ্ম নাম)। তিনি চট্টগ্রাম কলেজে স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্রী। পড়াশুনার পাশাপাশি একটি অনলাইন পোর্টালে কাজ করছেন, সেই সাথে সপ্তাহে একবার বন্ধ থাকায়, ওই দিনটিও বসে না থেকে কাজে লাগিয়েছেন। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি থেকে মৌসুমী ফল এনে চট্টগ্রাম শহরে অনলাইন পেইজের মাধ্যমে বিক্রি করছেন। ইতোমধ্যে বন্দর নগরীতে আলাদা একটা পরিচয করে নিয়েছেন তিনি। এখন ব্যবসা আরোও বড় করার স্বপ্ন বুনছেন। তার দাবি অনলাইনে ব্যবসা করার জন্য যদি সরকারি সহায়তা পাওয়া যেত তাহলে ব্যবসার পরিধি আরো বাড়ানো যেত।
উপরের দুটি গল্পই সত্য। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই দুই তরুণ-তরুণীর কঠোর জীবন সংগ্রাম আমি খুব কাছ থেকেই দেখেছি।

শুধু কি প্রবীণ চাকমা? প্রতিদিন হাজার হাজার এমন প্রবীণ তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। করোনার আগেও যুগ যুগ ধরে ছিল এ সমস্যা। করোনা মহামারীতে তা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। চাকরি হারিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে পথে বসেছে বাংলাদেশের অসংখ্য পরিবার। বাংলাদেশে ২০১৭ সালের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ। আর তাঁদের মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ। সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে এখন বেকার ২৭ লাখ। আর শতাংশ হিসাবে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্ত করোনার কারণে দেশে বেকারত্ব বেড়ে দ্বিগুন হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কিন্তু এর শেষ কোথায়?কেন বাড়ছে বেকারত্ব?
আমি মনে করি বেকারের সংখ্যা বাড়ার পেছনে নিচের কারণগুলো অনেকাংশে দায়ি।
১. যে কোনো প্রকারে সরকারি চাকরি লাভের মানসিকতা
২. যোগ্য প্রার্থীর তুলনায় পর্যাপ্ত চাকরি না থাকা
৩. চাকরির বাজারে নিজেকে যোগ্য না করা
৪. প্রযুক্তির ব্যবহার না জানা
৫. নিয়োগদাতাদের অভিজ্ঞ প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতা
৬. ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন না করা
৭. কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশ না থাকা
৮. চাকরি খোঁজার চেয়ে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা না করা

 

সমাধান
দেশে শ্রমশক্তির একটি বিরাট অংশ এখন কর্মহীন। তাই কারিগরি শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে। প্রত্যেকটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়নে বেকারদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে জেলা সদরে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহন করা একেবারেই অসম্ভব।

সেই সাথে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে। সেই সব কেন্দ্রে শিক্ষিত বেকারদের অর্জিত সার্টিফিকেটের ওপর ভিত্তি করে প্রশিক্ষণের ধরণ নির্ণয় করে প্রশিক্ষণ দিতে হবে । এই প্রশিক্ষণ দেশ কিংবা বিদেশে কাজের জন্য সহায়ক হবে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর সুযোগ থাকতে হবে।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আগ্রহ জাগানোর জন্য প্রচারে গুরুত্ব দিতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে টেলিভিশনে ছোট ছোট নাটিকা কিংবা ব্রিফিং মাধ্যমে প্রচারণা করেতে হবে। প্রশাসনের মাধ্যমেও প্রশিক্ষণে আগ্রহ জাগানোর কাজ করতে হবে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে।
বেকারত্ব নিরসনে কুটির শিল্পের গুরুত্বও অপরিসীম। কুটির শিল্পে নারীদের ভূমিকা বেশি। কিন্তু বর্তমান সময়ে আগের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্পের কার্যক্রম কমে যাচ্ছে। কুটির শিল্পের মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে বেকার সমস্যা হ্রাস পাবে।

এবার দ্বিতীয় গল্পটির জুম্মবি চাকমা(ছন্দ নাম)। তিনি শত বাধা পেরিয়ে সে  স্বাবলম্বী হয়ে নিজেকে গড়ে তুলছেন। এরকম আরোও অনেকে আছে, যারা অনলাইন প্লাটফর্মকে বেছে নিয়েছে। বিশেষ করে করোনার এই টালমাটাল সময়ে। কিন্ত যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে তারা আরো গতিশীল হতে পারছে না। কাস্টমারের সাথে বিশ্বাস এবং আস্থার সম্পর্ক কিভাবে তৈরী করা ,অর্ডার প্রসেসিংসহ নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে নিলার মতো অনেক উদ্যোক্তা। তাই সরকারি ভাবে এখনই প্রশিক্ষণের আওতায় এবং ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করলে বেকারের বিরাট অংশ উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী হবে। সমাজ থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নেবে বেকার নামে সামাজিক ব্যাধিটি।

 

 

এই বিভাগের আরও খবর