chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

আইন মানায় এতো অনীহা কেন

গতবার যখন বাংলাদেশে গিয়েছি ২০১৭ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের কামরায় (অফিসে) গিয়েছিলাম যিনি একটি বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং একটি উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ থেকে পিএইচডি শেষ করে সদ্য দেশে ফেরত গিয়েছেন। তার কামরাটি ছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং তার কামরায় বেশ কয়েকজন ছাত্রও ছিল।

কামরায় প্রবেশের খানিক পরেই প্রাথমিক কুশলাদির এক পর্যায়ে তিনি টেবিলের উপর রাখা সিগারেটের বাক্স থেকে একটি সিগারেট বের করে ধরালেন। যেহেতু আমি ধূমপান করিনা এবং কামরাটি সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ায় ধোঁয়া আটকে যাওয়াতে আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবে বেশী অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে একজন সচেতন মানুষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হয়েও তিনি কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় বসে ধূমপান করতে পারলেন।

আমি যতদূর জানি, বাংলাদেশে আইন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ আরও বেশ কিছু পাবলিক প্লেসে (public place) ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি খুব আশ্চর্য হয়ে উনাকে বললাম আপনি এই রকম একটি বদ্ধ কামরায় বসে সিগারেট খাচ্ছেন!! তিনি আমার কথাটি হেসে উড়িয়ে দিলেন আর বললেন এটা বাংলাদেশ। কিচ্ছু হবে না, এখানে কেউ নিয়ম বা আইন মানেনা।

এই প্রসঙ্গটি এখানে আনলাম এই কারণে যে, বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষই আইন মানতে চায় না–আসলেই নিয়ম বা আইন মেনে না চলাটাই যেন নিয়ম। সমাজে যারা শিক্ষিত, যাদের সামাজিক পদমর্যাদা অন্যদের থেকে বেশী, যারা সমাজে তুলনামূলক ভাবে ক্ষমতাবান, যারা নিজেরাই আইন কানুন প্রয়োগের সাথে সংশ্লিষ্ট, যারা অন্যদের আইন মেনে চলার উপদেশ দেন হর হামেশাই, তারাই যখন তখন আইন ভঙ্গ করেন।

গাড়িতে বসা সরকারি কর্তা ব্যাক্তিটিই ড্রাইভারকে বলেন লাল বাতি অমান্য করতে বা উল্টো রাস্তায় গাড়ি চালাতে। সরকারী দপ্তরে গিয়ে যখন আমরা কাউকে খুঁজি যে আমার কাজটি আগে করে দিবে অন্যদের ডিঙ্গিয়ে কিছু অর্থের বিনিময়ে বা আমার ক্ষমতার কারণে, বা একটু কম হাঁটা হবে বলে নিদিষ্ট জায়গা দিয়ে রাস্তা পার না হয়ে ভয়ঙ্কর হবে জেনেও যেখান সেখান দিয়ে রাস্তা পার হই, আমরা কিন্তু তখন অপরাধই করি। এরকম হাজারও অপরাধের উদাহরণ বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকেই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দিতে পারেন।

আইন আপাত দৃষ্টিতে যত তুচ্ছ মনে হোক না কেন, যদি আইনটি করা হয় জনগণ এবং সমাজের কল্যাণের জন্য, তবে সে আইনটি সবারই মেনে চলা উচিৎ। মনে রাখা দরকার যে অপরাধের আইনি সংজ্ঞা হচ্ছে যে আচরণ আইন ভঙ্গ করে। আর এইদিক থেকে আইন ভঙ্গকারী, সে আইন যতই তুচ্ছ হোক না কেন, একজন অপরাধী। আর নিজে অপরাধী হয়ে আরেকজনকে অপরাধ থেকে বিরত থাকার কথা বলা বা অপরাধীদের জন্য শাস্তির কথা বলা হচ্ছে হঠকারিতা যাকে ইংরেজিতে বলা হয় hypocrisy.

অপরাধবিজ্ঞানী এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে বড়রা যদি ছোটদের সাথে এবং সামনে আইন বা নিয়ম না মেনে চলে, তবে ছোটরাও আইন না মানার দিকে আকৃষ্ট হয়, বড় হয়ে আইন ভঙ্গ করার প্রবণতা তাদের মধ্যে তৈরি হয়। সন্তান এবং শিশু কিশোররা তাদের পিতা মাতাকে দেখে থাকে আদর্শ (রোল মডেল) হিসেবে এবং নিজের অজান্তেই তারা বাবা মা বা পিতৃ-মাতৃতুল্যদের আচরণ অনুকরণ এবং অনুসরণ করা শুরু করে যা তারা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরও চলতে থাকে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে যখন একটি ছেলে শিশু তার বাবাকে দেখে মাকে শারীরিক নির্যাতন করতে সে শিশুটি  বড় হয়ে তার স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করার সম্ভাবনা অনেক বেশী হবে। শুধু তাই নয়, সেই শিশুটি খুব সম্ভবত বড় হবে একদিকে বাবাকে ঘৃণা করে আর অন্য দিকে মেয়েদের প্রতি অবজ্ঞার মনোভাব নিয়ে। একজন শিশু যখন দেখে অভিভাবক স্থানীয় একজন ঘরে থেকেও পাওনাদার বা অন্য কাউকে ফোনে বলে আমি তো বাসায় নাই, বাইরে–শিশুটির ধারনা হবে যে মিথ্যা বলা বা প্রতারণা করাটা খুবই স্বাভাবিক এবং সেও খুব সম্ভবত প্রতারণার ভিতর দিয়ে এবং প্রতারণা করতে করতে বড় হবে এবং বড় হয়ে মিথ্যা বলবে এবং প্রতারণা করবে। একটি শিশু যখন দেখে যে তার পারিবারিক গণ্ডিতে বড়রা সবসময় অন্যদের সমালোচনা করছে বা পরনিন্দা/পরচর্চায় ব্যস্ত আছে, সে শিশুটি খুব সম্ভবত সব মানুষের মাঝেই দোষ খোঁজার চেষ্টা করবে এবং মানুষের উপর তার আস্থা কম থাকবে যা তার মানস জগতে অন্যদের প্রতি নেতিবাচক ধারনার জন্ম দিবে। এই ধরনের বিষয়গুলো আপাত দৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হলেও অনেক অপরাধ বিজ্ঞানী মনে করেন যে এইগুলো শিশু কিশোরদের অপরাধী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আমরা যদি অপরাধ প্রতিরোধ করতে চাই তবে একক ভাবে পরিবারের গণ্ডিতে আমাদের সবাইকে আইন এবং সামাজিক নীতি গুলো মেনে চলতে হবে। আর এক এক করেই যেহেতু সমষ্টি, সমাজ, এবং রাষ্ট্র হয়, সবাই যার যার অবস্থান থেকে আইন মেনে চললে—তা যত ছোটই হোক না কেন—আমরা শুধু মাত্র ছোট অপরাধ নয়, বড় অপরাধ গুলোও প্রতিরোধ করতে পারবো। আমাদের মনে রাখা উচিৎ যে সমাজে অপরাধের হার কম হওয়া মানে অপরাধের শিকারের (victim) সংখ্যাও কম হওয়া।

এই বিভাগের আরও খবর