chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

শতবছরের আক্ষেপঃ চট্টগ্রামে এডমিরালটি কোর্টসহ হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার দাবি পূরণ হবে কবে?

এ এম জিয়া হাবীব আহ্সান

ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ১২৫ বছর পূর্তি হলো। কিন্তু আজো চট্টলবাসীর প্রাণের দাবী দেশের প্রধান বন্দর নগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বার আউলিয়ার আবাদভূমি চট্টগ্রামে একটি স্থায়ী হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা হলো না। চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের একটি চাওয়া পাওয়ার সোনার হরিণ “স্থায়ী হাইকোর্ট বেঞ্চ”। যদিও বর্তমানে দাবিটি সংবিধান সম্মত নয়, তবুও রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এ দাবির যৌক্তিকতা বিবেচনা করে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর সময়ও বর্তমানে এসে গেছে। এ প্রত্যাশার ভিত্তিতে আমার এ প্রবন্ধের অবতারণা। ১৮৮২ সালে ব্রিটিশ শাসনের সুবিধার্থে কলকাতায় একজন গর্ভনরের পদ সৃষ্টি করা যায় কিনা প্রশ্নে একটি কমিশন গঠিত হলে এর রিপোর্টে বলা হয়- প্রশাসনিক দিক থেকে শুধু কলকাতাকে লেঃ গভর্নরের মর্যাদা দেয়ার সার্বিক প্রয়োজনীয়তা যেমনি রয়েছে তেমনি সমপর্যায়ে গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে চট্টগ্রামেরও অনুরূপ স্বীকৃতির। কারণ কলকাতায় যেমন নৌ-যোগাযোগের সুবিধা রয়েছে তেমনি চট্টগ্রামেও একই সুবিধা রয়েছে। কারণ দুটিই বঙ্গোপসাগরের সীমানায় অবস্থান করছে। তদুপরি প্রাকৃতিক দিক থেকে চট্টগ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে। অতএব, প্রশাসনিক দিক থেকে চট্টগ্রামকেও কলকাতার সমপর্যায় গুরুত্ব দিয়ে অত্র জেলার জন্য একটি লেঃগর্ভনরের পদ সৃষ্টির জন্য সুপারিশ করা গেল (ব্রিটিশ ইন ইন্ডিয়া/ স্যার এডমন্ড এফ, গিল্ড/ পৃঃ ১২৭= ১৩১)। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিদেশী শাসক গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে চট্টগ্রাম একটি সম্ভাবনাময়ী নগরী হিসেবে স্বীকৃত। আদিকাল থেকে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক এবং সামরিক কৌশলগত দিক থেকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের প্রায় প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে চট্টগ্রামের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এতদসত্ত্বেও চট্টগ্রাম বরাবরই সার্বিক দিক থেকে অবহেলিত, বঞ্চিত। দেশের কর্ণধারদের চিন্তা-চেতনা সর্বদা ঢাকা কেন্দ্রিক হওয়ায় দেশের সার্বিক উন্নয়ন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হয় প্রচলিত অর্থে, কার্যত এটা বাণিজ্যিক রাজধানী নয়। কারণ এখানে এর আনুষঙ্গিক উপায় উপকরণ স্থাপন করা হচ্ছে না। কোন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় আজো চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়নি। বরঞ্চ যেগুলো ছিল সেগুলোও ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর হওয়া সত্ত্বেও নেভাল হেড কোয়ার্টার ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা অযৌক্তিক ও বাস্তবতার পরিপন্থীও বটে। রেলওয়ের হেড কোয়ার্টারও স্থানান্তরের প্রয়াস চলবে। আজ শুধু আলোচনা করবো চট্টগ্রামে উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার আকুল আবেদন নিয়ে। দীর্ঘ দিন যাবত চট্টগ্রামের আইনজীবী সহ চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ বন্দর নগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে একটি পূর্ণাঙ্গ হাইর্কোট বেঞ্চ স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়ে আসছেন। কেউ কেউ সার্কিট বেঞ্চের দাবী জানালেও আমি মনে করি তা দেশের অন্য বিভাগের জন্য প্রযোজ্য, চট্টগ্রামের জন্য প্রয়োজনীয় স্থায়ী বেঞ্চ ।

এ জন্যে প্রয়োজনে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এর সংশোধনের বিধানও রাখা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, পার্লামেন্ট সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের যে কোন বিধানের পরিবর্তন করতে পারে, এমনকি সরকারের ধরনও (অনুঃ ১৪২) পরিবর্তণ করতে পারে। সংবিধান প্রণয়নের কোন মৌলিক উদ্দেশ্য ব্যাহত না হলে এ ধরনের সংশোধন বৈধ। আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী মানুষ বর্তমানে ঢাকা হাইকোর্টে মোকদ্দমার আধিক্য, বিচারপ্রার্থী জনতার হয়রানি ও আর্থিক দুর্দশা থেকে রেহাই দিতে দেশের ২য় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ পুনঃস্থাপনের জন্য সরকার এবং জাতীয় সংসদের সম্মানিত সদস্যদের প্রতি জোর দাবি জানিয়ে আসছেন। চট্টগ্রামে হাইকোর্টের স্থায়ী কোন বেঞ্চ না থাকায় চট্টগ্রামের বিচার প্রার্থী লোকজনকে ঢাকায় নানা ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ১৯৮৩ সালে আগ্রাবাদ জাম্বুরী মাঠের পাশে মোট ২৭,০০০ বর্গফুট আয়তনের ভবনে ৪৪ কক্ষ বিশিষ্ট দুটি এজলাসসহ হাইকোর্টের একটি স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা হলেও পরবর্তীতে সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর বিপরীতে সুপ্রীমকোর্টের একটি আদেশের মাধ্যমে তা বাতিল করা হয়। সেই থেকে চট্টগ্রামে বিচার প্রার্থী লোকজনকে আবার ঢাকায় দৌড়াতে হচ্ছে। ভারতের বিচার ব্যবস্থায় ভারতের বিহার, উড়িষ্যা এক সময় কলকাতা হাইকোর্টের আওতাধীন ছিল। কালের বিবর্তনে বর্তমানে বিহার, উড়িষ্যা ও কলকাতায় পৃথক পৃথক হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এদিক থেকে ভৌগলিক অবস্থান, গুরুত্ব ও স্থানের প্রেক্ষাপটের কারণে চট্টগ্রামেও হাইকোর্টের একটি স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।

১৯৮০৮২ এর দশকে চট্টগ্রামে একটি স্থায়ী হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যারা সবচেয়ে বেশী স্বেচ্ছায় ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে দৈনিক নয়া বাংলার সম্পাদক মরহুম আবদুল্লাহ আল ছগীরকে সবচেয়ে বেশী স্মরণ করি। কেননা তিনি চট্টগ্রামে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রেসিডেন্ট এরশাদ আমলে তার পত্রিকার ১ম পৃষ্ঠায় বিশেষ সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। আইনজীবীদের মধ্যে এ ব্যাপারে মরহুম আজিজুল হক চৌধুরী, মরহুম খান শফিকুল মান্নান, একেএম আমিনুল ইসলাম, আলহাজ্ব বদিউল আলম, আলহাজ্ব মোঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আলহাজ্ব আবদুল মান্নান, মুহাম্মদ আমিন চৌধুরী, ব্যারিস্টার মাহাবুবুল কবির চৌধুরী, ইউএন সিদ্দিকী, মোঃ গোলাম

মোস্তফা, ফরিদুল আলম চৌধুরী প্রমুখের নাম প্রণিধানযোগ্য। তারা আজ বেঁচে না থাকলেও তাদের হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার দাবি ও আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছিল। বিশেষ করে শ্রদ্ধেয় মরহুম এডভোকেট আলহাজ্ব নুরুল হুদা সাহেব এ ব্যাপারে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন যা সকলের জন্য প্রেরণাস্বরূপ। তিনি এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে ঢাকা কেন্দ্রীক আইনজীবীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় আইনজীবী ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিল্কী, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, একেএম আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, এডভোকেট সুভাষ চন্দ্র লালা, এএইচএম মোজাফ্ফর আহমদ খান, একেএম শামসুল হুদা, এসএম শামসুল ইসলাম, আলহাজ্ব এসএ মির্জা, মোঃ ওমর হায়াৎ, আবু জাফর চৌধুরী প্রমুখ সহ আরো অনেক আইনজীবী তাদের বক্তৃতায়, লেখনিতে সর্বত্র চট্টগ্রামে একটি স্থায়ী হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা উপস্থাপন করে আসছেন।

চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার দাবী দীর্ঘদিনের। আইয়ুব আমলে পাকিস্তান বার কাউন্সিলের এক বৈঠকে তৎকালীন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার সাইফুদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী ও বার কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার সলিমুল হক মিল্কী এ দাবি প্রস্তাবাকারে উদ্যত মর্মে তথ্য পাওয়া যায়। তৎকালীন এটর্নী জেনারেল শরফুদ্দীন পীরজাদার মাধ্যমে এ ব্যাপারে তৎপরতা চালানো হলেও নানা কারণে এ নিয়ে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। লাখো শহীদের আত্মত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক পরিষদে সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত ১৯৭২-এর সংবিধানের ১০০ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়, রাজধানীতে সুপ্রীমকোর্টের স্থায়ী আসন থাকবে, তবে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে প্রধান বিচারপতি সময়ে সময়ে অন্য যে কোন স্থান বা স্থান সমূহ নির্ধারণ করবেন এবং সে স্থান বা স্থান সমূহের হাইকোর্ট বিভাগের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে পারবে। যাতে সত্যিকার অর্থে জনগণের ঐকান্তিক ইচ্ছা বাস্তব প্রতিফলন ঘটে।

সাংবিধানিক রূপরেখা মোতাবেক চট্টগ্রামে বাংলাদেশের হাইকোর্টের একটি স্থায়ী বেঞ্চ ও শ্রম আপিলেট ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার জন্য বিগত ৭২ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের আইনজীবীদের সম্মেলনে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে জোর দাবী জানানো হয়। সমিতির তৎকালীন সহসভাপতি শ্রদ্ধেয় এডভোকেট বদিউল আলম ও সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট ওমর হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত দু’সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল রাজধানীতে অবস্থানকালে সাবেক গণপরিষদ সদস্য অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী ও সংবিধান খসড়া প্রণয়নকারী কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সমভিব্যহারে তদানিন্তন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের সাথে সাক্ষাৎ করে সমিতির দাবী সম্পর্কে অবহিত করলে ড. কামাল হোসেন এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেন এবং সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সার্বিক সাহায্যের আশ্বাস দেন।

পরবর্তীতে ২৬ শে জুলাই’ ৭২ সালে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির অপর এক সাধারণ সভায় মরহুম আবুল কাসেম, মরহুম বদিউল আলম, মরহুম ওমর হায়াত, স্বর্গীয় জ্যোৎস্না কুমার চৌধুরী, মরহুম একেএম আমিনুল ইসলাম পিপি, মরহুম আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, স্বর্গীয় চিত্তরঞ্চন দাশ, মরহুম আজিজুল হক চৌধুরীর সমন্বয়ে এক উপ-পরিষদ গঠন করা হয়। চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বেঞ্চ ও শ্রম আপিলেট ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আইনমন্ত্রী সকাশে স্মারকলিপি প্রদানের জন্য এ পরিষদের উপর সর্বসম্মত দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। কিন্তু বিগত বিভিন্ন সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, আইনের অনুশাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, সকল অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার অঙ্গীকার নিয়ে গত ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করার পর পরই বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণের পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বেঞ্চ বিভাগীয় সদর দফতরে স্থাপনের সরকারী সিদ্ধান্তকে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ২৩ এপ্রিল ১৯৮২ অনুষ্ঠিত এক সাধারণ সভায় স্বাগত জানিয়ে এ সিদ্ধান্তের আশু বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়।

গত ৩০ এপ্রিল ১৯৮২ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক সকাশে জেলা আইনজীবী সমিতি কর্তৃক জরুরি তারবার্তায় এবং এর ক’দিন পরেই ৩ মে সমিতির সভাপতি শ্রদ্ধেয় এডভোকেট মরহুম মোজাম্মেল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আহম্মদ সগির কর্তৃক প্রেরিত এক পত্রে পেশাগত দিক থেকে নয় বরং সামগ্রিক ভাবে জনগণ ও সরকারের বিঘোষিত লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি রেখে চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ স্থাপনের এক প্রস্তাব দেন। প্রায় একই সময় সমিতির তৎকালীন সভাপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে গত ৫ ও ১৫ মে ১৯৮২ ‘গ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল আবদুল মন্নাফ এর সাথে সাক্ষাত করে এবং তারা চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ স্থাপনের ব্যাপারে তাদের বক্তব্য অবহিত করেন। সমিতির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও আলহাজ্ব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিল্কী, মরহুম আবদুল মান্নান, আলহাজ্ব এসএ মীর্জা ও মোহাম্মদ আমিন চৌধুরী এ দলের সদস্য ছিলেন। ৪ মে জেলা আইনজীবী সমিতির এক বিশেষ সাধারণ সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তে ১৪ মে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক সমীপে সমিতির পক্ষ থেকে প্রদত্ত অপর এক পত্রে এবং জেলা পরিষদ মিলনায়তনে জেনারেল এরশাদ-এর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সর্বস্তরের নাগরিকের এক সভায় জেলা আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি তাঁর ভাষণে চট্টগ্রামে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার দাবী পুনরুল্লেখ করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে সমিতির পক্ষ থেকে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রীর নিকট ‘চট্টগ্রামে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার দাবী’ শীর্ষক একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়।

চট্টগ্রাম হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার দাবীর প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির উদ্যোগে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্তরের সংগঠনের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরযুক্ত সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের নিকট ‘চট্টগ্রামে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার আবেদন’ শীর্ষক বিজ্ঞপ্তি বিগত ২৮ মে, ১৯৮২ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়।

শুধু আইনজীবী নন, চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান। তাছাড়া স্থানীয় সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় প্রকাশ, সংবাদ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার দাবীকে জোরদার করতে সচেষ্ট হন। ২৪ মে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের চট্টগ্রাম সফর উপলক্ষে দৈনিক নয়া বাংলা হাইকোর্টের স্থান সম্পর্কে “বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ কোথায়” শীর্ষক প্রথম পৃষ্ঠায় এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এরই মধ্যে ১৯৮২ সালের জুন মাসের প্রথম দিকে হাইকোর্ট বিভাগের ঢাকা বেঞ্চ, কুমিল্লা বেঞ্চ, রংপুর বেঞ্চ ও যশোর বেঞ্চ স্থাপনের সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির উদ্যোগে গঠিত ‘হাইকোর্ট সমন্বয় কমিটি’ এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে হাইকোর্ট বেঞ্চ সমূহের পূর্ববস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং এর ঐক্য সংরক্ষণের উপর জোর গুরুত্ব আরোপ করেন। জেলা আইনজীবী সমিতি হাইকোর্ট সমন্বয় কমিটির এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। গত ৭ জুন অনুষ্ঠিত এক সাধারণ সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলা নিয়ে চট্টগ্রাম হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রয়াস চালানোর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সরকারের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে সমিতির কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে তাদের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে সচেষ্ট হন। মহামান্য সংঘ নায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো, মেজর জেনারেল (অবঃ) ইস্কান্দর করিম, ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির নুরুল ইসলাম চৌধুরী, এএস আনোয়ার প্রমুখ এ ব্যাপারে তাদের সাহায্য ও সহায়তা প্রদান করেন।

বিগত ২৫ অক্টোবর ১৯৮২ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সাথে দেশের আইনজীবী সমিতির সদস্যদের অনুষ্ঠিত বৈঠকে তিনি চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বেঞ্চ অচিরেই স্থাপন করার প্রতিশ্রতি দেন। এরপর দিনই আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কেএ বকর ওই বৈঠকে যোগদানকারী চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির দুই প্রাক্তন সভাপতি আলহাজ্ব এম নুরুল হুদা ও মোজাম্মেল হোসেন স্যারের সাথে পৃথক এক বৈঠকে চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে মত বিনিময় করেন। পরবর্তীতে ঐ বছরের গত ৬ নভেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় সমিতির সম্মেলন উদ্বোধন কালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেনেন্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ চট্টগ্রামে একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করেন। ৯ নভেম্বর সমিতির তৎকালীন সভাপতি ও সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর আমিনুল ইসলামের সাথে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের চট্টগ্রাম হাইকোর্ট বেঞ্চের স্থান নির্বাচনের বিষয় আলোচিত হয়। ৯ নভেম্বর চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কাছে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রেরিত একটি পত্রে চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপনের ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয় এবং এতদসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয় হয়।

২০ নভেম্বর ১৯৮২ বৌদ্ধদের কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠানে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার কথা পুনরুল্লেখ করেন। এর পরের দিন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হাইকোর্টের স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল আবদুল মন্নাফের সাথে সাক্ষাৎ করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম হাইকোর্ট বেঞ্চের স্থান নির্বাচনের জন্য সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব (তদানিন্তন যুগ্মসচিব) বিচারপতি এ. কুদ্দুস চৌধুরী বিগত ডিসেম্বরের শেষ ভাগে চট্টগ্রামে আসেন এবং তিনি জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তাদের নিয়ে বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন এবং চূড়ান্ত ভাবে আগ্রাবাদের জাম্বুরী মাঠের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ ভবনের উত্তরাংশকে হাইকোর্ট বেঞ্চের ভবন হিসেবে নির্বাচন করেন। পরবর্তীতে আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী কে এ বকর এই ভবনটি পরিদর্শন করেন এবং হাইকোর্ট বেঞ্চের ভবন হিসেবে এই স্থানটি চূড়ান্ত ভাবে অনুমোদন করেন।

চট্টগ্রামের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপনের ব্যপারে যে ব্যক্তিত্বের কথা বার বার আইনজীবীদের স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে তিনি হচ্ছেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির একজন বিজ্ঞ সদস্য ও সর্বমহলের সুপরিচিত মরহুম এডভোকেট খান শফিকুল মান্নান। আইনজীবীদের এই কর্ম প্রচেষ্টার শুরু থেকে তার অগ্রণী ভূমিকা ও সক্রিয় সহযোগিতা সংশ্লিষ্টদের যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করেছে।

আগ্রাবাদস্থ ঔষধ রসায়ন পরীক্ষাগার ভবনটি অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে হাইকোর্ট বিভাগের চট্টগ্রাম বেঞ্চ হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং এর মাধ্যমে চট্টগ্রামের জনগণের র্দীঘদিনের একটি স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করে। সামাজিক ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এ উচ্চতর আদালত গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিল এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যেতে পারে।

১৯৬৯-৭০ সালের দিকে তদানিন্তন গণপূর্ত বিভাগ আগ্রাবাদের জাম্বুরী মাঠের পাশে ৬ দশমিক ৫৫ একর জায়গার উপর হাইকোর্টের একটি স্থায়ী ভবনের কাজ শুরু করে এবং তার নির্মান কাজ ১৯৭২ সালে সমাপ্ত হয়। ১৯৮৩ সালে ১৮ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হাইকোর্টের জন্য ৪৪ কক্ষ বিশিষ্ট ভবনটি আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করে। ভবনে হাইকোর্টের এজলাসের জন্য দুটি কক্ষও বরাদ্দ করা হয়েছিল। চট্টগ্রামে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপনের ফলে এ এলাকার জনসাধারণের তুলনামুলক ভাবে অত্যন্ত কম সময় ও কম খরচে নতুন বিচার ব্যবস্থার সুফল ভোগ করেছিল এবং যোগ্য আইনজ্ঞ ও বিচারক সৃষ্টির পথ সুগম হয়।  কিন্তু পরবর্তীতে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তা বাতিল করলে বিচার প্রার্থী লোকজনের মধ্যে ভোগান্তি বৃদ্ধি পায়। আমি আমার মরহুম আইনজীবী পিতা এডভোকেট আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যাহ’র হাত ধরে সেখানে বারবার যাওয়ার সুযোগ পাই।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৬ষ্ঠ ভাগে বিচার বিভাগ সম্পর্কে সাংবিধানিক ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। ১ম পরিচ্ছেদে ৯৪(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট’ নামে বাংলাদেশের একটি সর্বোচ্চ আদালত থাকবে এবং আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ লইয়া তা গঠিত হবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রধান বিচারপতি, সময়ে সময়ে অন্য যে স্থান বা স্থান সমূহ নির্ধারণ করেন, সে স্থান সমূহে হাইকোর্ট বিভাগের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে পারবে। সংবিধানের (৮ম সংশোধনী) আইন ১৯৮৮ বলে ১০০ অনুচ্ছেদে সংশোধন করা হয়েছিল। যাতে ১৯৮৮ সালের ৩০ নং আইন বলে সংশোধিত ১০০ অনুচ্ছেদে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, যশোর, রংপুর এবং সিলেট-এ হাইকোর্ট বিভাগের একটি করে স্থায়ী বেঞ্চ থাকার বিধান রাখা হয়। এতে প্রধান বিচারপতি সময়ে সময়ে যেরূপ স্থান নির্ধারণ করবেন, প্রত্যেক স্থায়ী বেঞ্চের সেরূপ বেঞ্চসমূহ থাকার বিধান রয়েছে। কিন্তু সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদের ৮ম সংশোধনী আইন, ১৯৮৮ এর মাধ্যমে এতদসংক্রান্তে যে সংশোধন আনয়ন করা হয়েছিল তা সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ ১৯৮৯ সালে এখতিয়ার বহির্ভূত ও অকার্যকর ঘোষনা করে। ফলে মূল ১০০ অনুচ্ছেদটি পুনঃবহাল করা হয়। এতে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, যশোর, রংপুর এবং সিলেটে প্রতিষ্ঠিত হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ সমূহ বাতিল করে রাজধানী ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।

৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১০০নং অনুচ্ছেদে যে সংশোধনী আনা হয় তাকে হাইকোর্ট বিভাগে ২টি পৃথক রীট পিটিশনের মাধ্যমে অসাংবিধানিক ও ক্ষমতাবহির্ভূত বলে চ্যালেঞ্জ করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগে ১৯৮৮ সালের ১৫ আগষ্ট রীট পিটিশনগুলোকে খারিজ করে দেয়। আপিল বিভাগ আপিলের অনুমতি দেয়।

আপিল বিভাগ এ মামলায় রায় দিয়েছিল যে, ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১০০নং অনুচ্ছেদের যে সংশোধন করা হয়েছে তা অসাংবিধানিক, ক্ষমতা বর্হিভূত এবং অকার্যকর। সুতরাং ৮ম সংশোধনীর যে অংশটুকু ১০০নং অনুচ্ছেদকে সংশোধন করেছিল সেই অংশটুকু বাতিল হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এটিই প্রথম মামলা যার মাধ্যম সংবিধান সংশোধন ক্ষমতার উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হলো  এবং পার্লামেন্টের সংবিধান সংশোধন ক্ষমতার উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হল। প্রশ্ন হলো আদালত কিসের ভিত্তিতে সংবিধান ৮ম সংশোধনীকে বাতিল ঘোষনা করলো। সংবিধানের ১৪২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সংবিধানের যে কোন বিধান সংশোধন করা যাবে। অর্থাৎ সাধারণ আইন নয়; সংবিধান সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানের যে কোন অংশ পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, সংযোজন, রহিতকরণ করা যায়।

 

সুতরাং ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১০০ নং অনুচ্ছেদের যে পরিবর্তন করা হয়িেছল তা অসাংবিধানিক ও ক্ষমতা বহির্ভূত হওয়ার কথা নয় ৷ কিন্তু তারপরও আদালত ক্ষমতা বহির্ভূত ঘোষণা করল । এর কারণ মামলার রায় বিবেচনা করলে বোঝা যাবে । মামলার রাযরে মুল যুক্তিগুলো ছিল নিম্নরূপ

 

১। সংবিধানের কতিপয় মৌলিক বৈশিষ্ট্য বা কাঠামো রয়েছে যা পার্লামেন্ট তার সংশোধনী ক্ষমতা বলে সংশোধন করতে পারে না । কারণ এই মৌলিক কাঠামোগুলোকে সংশোধন করার ক্ষমতা দিলে সংবিধান তার মৌলিকত্ব হারিয়ে ফেলবে ৷ এরূপ মৌল কাঠামোর মধ্যে কতগুলো হলো-

 

ক) জনগণই সকল সার্বভৌমত্বের মালিক,

খ) সংবিধানের প্রাধান্য,

গ) গণতন্ত্র,

ঘ) প্রজাতান্ত্রিক সরকার,

ঙ) এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র,

চ) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ১

 

এই মৌল কাঠামোগুলো সংসদের সংশোধনী ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করে ৷ সুতরাং যদি এগুলো কোনো সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয় তাহলে সুপ্রীম কোর্টের ক্ষমতা আছে ওই সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করার ৷ ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে ১০০ নং অনুচ্ছেদের যে পরিবর্তন করা হয়েেছ তা সুপ্রীম কোর্টের একাধিক স্থায়ী আসন তৈরী করেছে এবং এটি বিচার বিভাগের যে এককেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল তাকে ধ্বংস করেছে এবং এক স্থায়ী বেঞ্চ থেকে অন্য বেঞ্চে বিচারকদের বদলির মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ক্ষুগ্ন করার পথ করে দিয়েছ ৷ সুতরাং ওই সংশোধনী সংবিধানের ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা’ নামক মৌল কাঠামো ধ্বংস করেছে । তাই উক্ত সংশোধনী বাতিল ও ক্ষমতা বহির্ভূত ।

 

২। সমগ্র প্রজাতন্ত্রের বিচার বিভাগীয় চূডান্ত ক্ষমতা সুপ্রীম কোর্টের উপর ন্যস্ত৷ কিন্তু ৮ম সংশোধনী হাইকোর্ট বিভাগীয় স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের মাধ্যমে উক্ত ক্ষমতাকে কেড়ে নিয়েছে ৷ তাছাডা এই সংশোধনী সংবিধানের ৪৪ ৯৪, ১০১, ১০২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী ৷ সৎশোধনীটি ১০৮, ১০৯, ১১০, ১১১ এবং ১১২ অনুচ্ছেদকে অর্থহীন করেছে এবং এটি প্রত্যক্ষ ভাবে ১১৮ অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করেছে ৷ তাছাড়া একটি স্থায়ী বেঞ্চ থেকে অন্য বেঞ্চে মামলা হস্তান্তরের কোন বিধান সংশোধনীতে করা হয়নি ৷ সুতরাং সংশোধনীটি অবৈধ ও অসাংবিধানিক।

 

৩। সংবিধানের কোন বিধানকে যদি দিক নির্দেশিকা ধরা যায় তবে তা হলো সংবিধানের প্রস্তাবনা। প্রস্তাবনাকে যে কোন সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা যাচাইয়ের জন্য পরশপাথরের সাথে তুলনা করা যায় ৷ পার্লামেন্ট যেহেতু প্রস্তাবনাকে সাধারণ সংশোধনী ক্ষমতা বলে পরিবর্তন করতে পারে না সুতরাং পরোক্ষভাবে পার্লামেন্ট সাধারণ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রস্তাবনায় উল্লেখিত কোন উদ্দেশ্যকে ক্ষতিগ্রস্থ বা বানচাল করতে পারে না । ৮ম সংশোধনীর প্রস্তাবনার একটি উদ্দেশ্যে তথা আইনের শাসনের কাঠামোকে ধ্বংস করছে। সুতরাং এটি প্রস্তাবনার বিরোধী হওয়া অসাংবিধানিক ।

 

উপরোক্ত রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বলা, ৮ম সংশোধনীকে বাতিল করার পেছনে তিনজন বিচারপতিই একটি যুক্তির উপর সর্বাধিক ঝুঁকেছেন ৷ সেটি হলো সংবিধানের ‘মৌল কাঠামো’ ৷ বিচারপতি এম এইচ রহমান যদিও সরাসরি মৌল কাঠামোর উপর নির্ভর করেননি তথাপিও প্রস্তাবনাকে তিনি পরোক্ষভাবে ‘মৌল কাঠামো’ ধরে নিয়েেছন ৷ কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে চট্টগ্রামে একটি স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠারও গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ব্যাপারে পার্লামেন্টে কোন সিদ্ধান্ত নিলে তা মহামান্য উচ্চ আদালত নিশ্চই নতুন আঙ্গিকে বিবেচনা করবেন এটিই লেখকের ধারণা ৷ পার্লামেন্ট যাতে যখন তখন সংবিধানকে নিয়ে টানা হেঁচডা করতে না পারে তার জন্য ৮ম সংশোধনী মামলা একটি সতর্কতা স্বরূপ ৷ তবুও এ রায় বিতর্কিত, দেশের বৃহত্তর বন্দর নগরীতে হাইকোর্টের একটি স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা সংবিধানের মৌল কাঠামো রক্ষা নীতিকে খর্ব করবে মর্মে খোঁডা যুক্তি মেনে নেয়া যায় না । বরঞ্চ এর ফলে জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার আরো সুসংহত হবে মাত্র ।

সরকার ব্যবসা-বাণিজ্য ও আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে ঢাকায় পরেই বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে গুরুত্ব দিয়ে থাকলেও এখানে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ না থাকার দরুন সুদৃঢ় অধিক্ষেত্র সংক্রান্ত মোকদ্দমার জন্য ঢাকার এডমিরালটি কোর্টের শরণাপন্ন হওয়া ছাডা বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই ও অথচ, হাইকোর্টের একটি স্থায়ী বেঞ্চ চট্টগ্রামে থাকলে এখানে এতদসংক্রান্ত মোকদ্দমা ছাডা এই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক দেওয়ানী, ফৌজদারী মোকদ্দমা, আপিল বিট, রিভিশন ইত্যাদির জন্য জনগণকে রাজধানীমুখী হয়ে থাকতে হতো না ও এ এলাকায় সামুদ্রিক আইন এখতিয়ার, কোম্পানি অইিন ও রিট এখতিয়ার নিষ্পত্তির জন্য চট্টগ্রামে (হাইকোৰ্ট ডিভিশন) বেঞ্চ পুনঃ প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে ও দুঃখজনক হলেও সত্য যে, হাইকোর্টে প্রাকটিসরত আইনজীবীদের অনেকেই চান না চট্টগ্রামে তথা দেশের অন্য কোথাও হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হোক। ঢাকার বাইরে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের ঢাকার একচ্ছত্র আইনপেশায় ভাটা পডার আশংকা থাকবে ও এটা সংকীর্ণ চিন্তা ছাড়া আর কিছুই নয় । অথচ তখন বেশি ফিস নিয়ে চট্টগ্রামে তারা মামলা করতে আসতে পারবেন।

 

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে এবং হাইকোর্ট বিভাগে অমীমাংসিত মামলার সংখ্যা দুই বিভাগের ধারণ ক্ষমতার বহির্ভূত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় জাতীয় সংসদে বিল এলে সংবিধানের প্রয়ােজনীয় সংশোধনী এনে চট্টগ্রামের হাইকোর্টের একটি স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করলে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে সহায়ক হবে । এতে চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্য ও সমুদ্র অধিক্ষেত্র সংক্রান্ত মামলা সমূহ সহজে নিষ্পত্তি হলে পুরো দেশ, লাভবান হবে ও ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানের ১০০ ধারায় বিধান রাখা হয় যে, তদানীন্তন প্রাদেশিক হাইকোর্ট অর্থাৎ ঢাকা হাইকোর্টটি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং দেশের অন্যান্য জায়গায় একই বেঞ্চ কাজ করতে পারবে ও যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির কারণে তখন দেশের বিভিন্ন গুরুতৃপূর্ণ স্থানে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপনের প্রয়ােজন সংবিধান রচয়তিারা অনুভব করলেও আর্থিক অসুবিধার কারণে অস্থায়ী ভিত্তিতে উক্ত বিধান রেখেছিলেন ও কিন্তু স্বাধীনতার ৩২ বছর পর জনসংখ্যা দ্বিগুণ হওয়া সত্বেও ঢাকা কেন্দ্রিক স্বার্থান্বেষী মহল চট্টগ্রাম হাইকোর্টের একটি স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে আসছেন সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অন্যায়ভাবে ও

 

বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার সামুদ্রিক আইন এখতিয়ার কোম্পানি আইন এখতিয়ার রিট সহ হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতাসহ একটি স্থায়ী বেঞ্চ বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠার দাবি অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত ৷ চট্টগ্রামে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হলে হাইকোর্ট বিভাগের গুণগত অবনতির যুক্তিও কেউ কেউ প্রদর্শন করে থাকেন ৷ অথচ এর গুণগত মানের ঐতিহ্য রক্ষার দায়ত্বি সম্মিলিতভাবে বিচারপতি ও অইিনজীবীগণের উপর যুগপৎভাবে বর্তায় ৷ বর্তমানে হাইকোর্টে অভিজ্ঞ আইনজীবীর যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ করার জন্যও চট্টগামে একটি স্থায়ী বেঞ্চ আবশ্যক ৷ কেননা এর ফলে এতদাঞ্চলে ভবিষ্যতে হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবীর দায়িত্ব পালনে সক্ষম অধিকসংখ্যক বিজ্ঞ আইনজীবী সৃষ্টির সূচনা হবে ও চট্টগ্রাম তথা শুধুমাত্র বাণিজ্যিক রাজধানীর গুরুত্বকে বৃদ্ধির জন্য এখানে একটি বেঞ্চ স্থাপন করাকে কোনমতেই হাইকোর্টকে বিভক্তিকরণ করা বুঝায় না ও দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির জন্য এতে হাইকোর্ট বিভাগের মর্যাদা আরো দ্রুত বৃদ্ধি পাবে ৷ বিচার বিভাগকে জাতীয় স্বার্থে আরো কার্যকর তথা বাস্তবতার নিরিখে চট্টগ্রামে একটি স্থায়ী বেঞ্চ অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ, যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত দাবি ও দেশের আর কোন অঞ্চলে এতবড সামুদ্রিক ও বাণিজ্যিক অধিক্ষেত্র ও মামলা মোকদ্দমার আধিক্য না থাকায় অন্য কোন অঞ্চলের জন্য এ-প্রয়ােজনীয়তা আপাতত নেই মর্মে লেখক মনে করেন ও কেননা চট্টগ্রামই দেশের অন্যতম ব্যবসা বাণিজের কেন্দ্রভূমি ৷ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকে এ অঞ্চল প্রণিধানযোগ্য।

 

সর্বশেষে জনসংখ্যা এবং মামলা মোকাদ্দমায় বহুগণ বৃদ্ধির জন্য সময়ের প্রয়োজনে চট্টগ্রামে একটি স্থায়ী হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে । সমুদ্র অধিক্ষেত্র সংক্রান্ত ও কোম্পানি বিষয়ে বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের সকলকে দৌড়াতে হয় । ফলে ভোগান্তির শেষ নেই । ঢাকা হাইকোর্টেও মামলার জট সৃষ্টি হয়েছে । বিধায় সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের একটি স্থায়ী হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার জরুরী দাবি জানাচ্ছি ।

চট্টগ্রামের জনগণ স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার দাবি করছেন রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ও কারণ চট্টগ্রাম থেকে উচ্চ আদালতে মামলা পরিচালনা ও তদবিবে অনেকে হয়রানি, আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ও বছরের পর বছর মামলার শুনানি হয় না ও হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপিত হলে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে ও জনগণের ভোগান্তি কমবে ৷ এ জন্য সংসদে বিশেষ উদ্যোগ নেয়ার জন্য চট্টগ্রামের মন্ত্রী-এমপিদের জোরালো ভূমিকা জরুরি ৷ এমতাবস্থায় চট্টগ্রামের সর্বস্তরের আইনজীবী, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও বিচারপ্রার্থী নাগরিকদের নিয়ে হাইকোর্ট পুনঃ প্রতিষ্ঠা আন্দোলন শুরু করা জরুরি ও

 

লেখকঃ মানবাধিকার, আইনজীবী, কলামিস্ট ও সুশাসনকর্মী