chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

ধর্ষক কি মৃত্যুদণ্ডের পরোয়া করে

একের পর এক ধর্ষণের ঘটনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এই পৈশাচিক অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার আইন কার্যকর করা হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন মৃত্যুদণ্ডের ভয়ে ধর্ষণের ঘটনা কমবে। বিষয়টি এমন যে যখন একজন উন্মত্ত মানুষ ধর্ষণ করার জন্য এগিয়ে যাবে মৃত্যুদণ্ডের কথা চিন্তা করে সে অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে, ফলে ধর্ষণের মত অপরাধের হার কমবে। ধারনা করা হচ্ছে যে মৃত্যুদণ্ডের অনুপস্থিতিই অপরাধের মুল কারণ। তবে বিষয়টি যত সরল মনে হচ্ছে বা সরলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে বাস্তবে তা কিন্তু ততটা সরল নয়; এটিকে অতি সাধারণীকরণ করে উপস্থাপনা করা হচ্ছে।

যদি কোনো অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয়, তবে এটি ধরে নেয়া যায় যে যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে সে সব দেশে ধর্ষণ বা হত্যাকাণ্ডের মত ভয়ানক অপরাধের হার কম হবে। আর যেখানে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই সেখানে এই ধরনের অপরাধগুলো বেশি হবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা কিন্তু তা নয়। আমরা জানি যে পৃথিবীর উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই, তবুও সে দেশগুলোতে ছিনতাই, ধর্ষণ, বা হত্যাকাণ্ডের মত অপরাধগুলোর হার তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মৃত্যুদণ্ডের বিধান না থাকা সত্ত্বেও কেন এইসব দেশে অপরাধের হার কম। আর এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের তাকাতে  হবে এইসব দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থা এবং বিচার ব্যবস্থার দিকে।

উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে আইন চলে নিজের নিয়মে, আদালতকে দেখা হয় একটি স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে এবং আদালতকে শাসক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার করা হয় না । এই দেশগুলোতে পুলিশকে দেখা হয় একটি দক্ষ নিরপেক্ষ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে। পুলিশ বাহিনীতে যোগদানের জন্য নূন্যতম  শিক্ষাগত যোগ্যতা ধরা হয় স্নাতক পাশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করেই কেউ যোগদান করে পুলিশ বাহিনীতে। পুলিশে নিয়োগ হয় নিরপেক্ষভাবে, সম্পূর্ণ যোগ্যতার ভিত্তিতে–রাজনীতি, ঘুষ, বা তদবিরের কারণে নয়। পুলিশের চাকরীকে সামাজিকভাবে অত্যন্ত মর্যাদা দেয়া হয়, আর বেতনও হয় বেশ ভালো। ফলে সংসার চালানোর জন্য পুলিশকে ঘুষের জন্য হাত বাড়াতে হয় না। আর তাই তারা আইন প্রয়োগও করতে পারে নিরপেক্ষভাবে।

এসব দেশে সন্দেহভাজন ব্যাক্তিকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয় না, আদালতে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নিরপরাধ হিসেবেই দেখা হয়। যেহেতু এসব দেশে আইন চলে নিজের নিয়মে, কেউ অপরাধ করলে তার শাস্তি অনেকটা নিশ্চিত–অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আর নিরপরাধ ব্যক্তিরও বিনা অপরাধে শাস্তি ভোগের আশংকা তেমন একটা থাকে না।

তবে একথা বলে রাখা ভালো যে, উন্নত, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থায়ও কেউ কেউ অপরাধ না করেও আদালতে দোষী প্রমাণিত হয়ে সাজা ভোগ করে থাকে। আর এসব দেশে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করার একটি প্রধান কারণও হচ্ছে এটি। যেহেতু মৃত্যুদণ্ড একবার কার্যকর হয়ে গেলে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ব্যক্তিটিকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না, ফলে যদি কোনোভাবে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেয়া হয় তবে সেটি হবে দেশের বিচার ব্যবস্থার জন্য একটি কলঙ্কজনক বিষয়।

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কখনো কখনো আইনের ফাঁকফোকড় গলিয়ে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায় এবং নিরপরাধীরা শাস্তি ভোগ করে দিনের পর দিন কারাভোগ করে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করার জন্য মিথ্যা মামলা করা আর সেই মামলার জের ধরে নিরপরাধ ব্যক্তিকে পুলিশ ধরে নিয়ে হাজতে ভরে দেয়া নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। আদালতে মিথ্যা মামলায় মিথ্যা সাক্ষী আর পুলিশের মিথ্যা রিপোর্টের কারণে দোষী প্রমাণিত হয়ে অনেক মানুষই শাস্তি ভোগ করছেন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে পুলিশের উপরে বাংলাদেশের মানুষের আস্থা খুবই কম, আর এটাও কোন গোপন তথ্য নয় যে পুলিশ ঘুষ খেয়ে প্রকৃত অপরাধীকে ছেড়ে দিতে এবং নিরপরাধ লোককে আদালতে বিচারের জন্য হাজির করতে। যেহেতু বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় পুলিশ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রায় দেয়া হয়, নিরপরাধী ব্যাক্তি যেমন খুব সহজেই  আদালতে অপরাধী প্রমাণিত হয়ে যেতে পারে, প্রকৃত অপরাধীও রাজনৈতিক, সামাজিক, বা আর্থিক ক্ষমতার কারণে ছাড়া পেয়ে যেতে পারে। আবার মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামির দণ্ড মওকুফ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও বিরল নয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দণ্ডবিধি পরিবর্তন করে অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার আগেও যেটি বেশী প্রয়োজন সেটি হচ্ছে বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাতে করে প্রকৃত অপরাধীরা কোনোভাবেই ছাড় না পায় আর নিরপরাধীরা যেন শুধু শুধু হেনস্তা না হয়। যখন একজন অপরাধী বা সুপ্ত অপরাধী জানবে যে অপরাধ করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে, অর্থ বা ক্ষমতার কারণে সে সাজা থেকে বাঁচতে পারবে না, তবে সে অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে এবং দেশে অপরাধের হার কমবে। রাষ্ট্রের যারা নীতি নির্ধারক, এটি নিশ্চিত করা তাদেরই দায়িত্ব।

ডঃ  মাহফুজুল ইসলাম খোন্দকার

অধ্যাপক, ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগ

কুজটাউন ইউনিভার্সিটি, পেনসিলভানিয়া

যুক্তরাষ্ট্র

এই বিভাগের আরও খবর