chattolarkhabor
চট্টলার খবর - খবরের সাথে সারাক্ষণ

আমার ভোট আমি দেব?

ভোট শব্দটা কে যে আবিষ্কার করেছিলেন, তা আমার জানা নেই। অনেক কিছুর আবিষ্কারের বিষয়েই তো আমরা জানি না। পরীক্ষা পাসের জন্য আগে বৈজ্ঞানিক কোনো কোনো বিষয়ের আবিষ্কারকের নাম মুখস্থ করলেও সেগুলোর অনেক এখন ভুলে গেছি। সবকিছুর আবিষ্কারকের নাম সবার জানারও কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যবহার জানাটাই যথেষ্ট। যেমন- আগুন কে আবিষ্কার করেছিল, তা নিয়ে অযথা মাথা ঘামানোতে কোনো কাজ নেই। আগুনের ব্যবহার জানতে পারলেই হল। ব্যবহার বলতে আমরা অবশ্যই সঠিক কাজে লাগার বিষয়টাই বিবেচনায় রাখি, অপব্যবহারটা নয়। কারও ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া কিংবা ভোটের সময় যত্রতত্র আগুন লাগিয়ে দেয়াকে অবশ্যই আগুনের যথাযথ ব্যবহার বুঝব না, যেমনটি বুঝব রান্নার কাজে আগুন ব্যবহারকে। তবে হালে ভোট আর আগুন যেন পাশাপাশি চলতে চায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০০৮-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির ভোটের আগের বছর থেকে যে জ্বালাও-পোড়াওয়ের কাণ্ড চলল, তা তো পরেও অনেকদিন চলেছে। আগুনকাণ্ড চললেও ভোট কিন্তু থেমে থাকেনি। ১৫৩ জন বিনা ভোটে সংসদ সদস্য হয়ে গেলেও কিছু ভোট তো হয়েছে। কীভাবে হয়েছে সেটা বড় কথা নয়, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সাংবিধানিক শর্ত রক্ষা তো হয়েছে, নাকি? গণতন্ত্রের জন্য ভোট বলে কথা যে!

তারপর উপজেলা, ইউনিয়ন, আরও কত ভোট হল। রকিব কমিশনের স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভোটের সময়ে তো খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার রকিব সাহেবই বিদেশে বেড়ানোয় ছিলেন। ভোটের সময়ে যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অবশ্যই দেশে থাকতে হবে, এমন তো কথা নেই। কিছু যদি ঘটানো হয় তাহলে দেশে থাকলেই বা কী হবে? মাগুরা নির্বাচনের সময়তো প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি রউফ দেশেই ছিলেন, তাতে কি কিছু হয়েছে? গত জাতীয় নির্বাচনের সময়ে অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তো পুরো নির্বাচন কমিশনই দেশে ছিল, তারপরও কি অভিযোগের শেষ আছে? কত কত ‘বেয়াদবি’ কথা আমাদের শুনতে হল। ভোটের আগের রাতেই নাকি সিল মেরে বাক্স ভরিয়ে রাখা হয়েছে, অনেক ভোটারকে নাকি কেন্দ্রে যেতেই দেয়া হয়নি, গ্রামাঞ্চলে নাকি এ কর্মটি বেশি হয়েছে। আবার কার ভোট নাকি কে দিয়ে ফেলেছে, ইভিএম নামক একটা ‘ফালতু’ মেশিনেও নাকি ভোট জালিয়াতি হয়েছে। ভোটের দায়িত্বে যারা ছিলেন তারাও নাকি অনেকে এসব কর্মে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন, ইত্যাদি। অবশ্য পরে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্যও প্রায় কসম খেয়েই সাক্ষী দিলেন যে, ভোট সুষ্ঠু হয়নি। তাতে কী, তারপরও তো তিনি বেহায়ার মতো সংসদ সদস্য রয়েই গেলেন, তার জোটও কিছুটা হম্বিতম্বি করে শেষতক চুপ করে গেল। ভোট যেমনই হোক, ক্ষমতায় থাকা বলে কথা। ‘তোরা যে যাই বলিস ভাই আমার ক্ষমতায় থাকা চাই!’ এখন আরও নতুন সংস্করণ- আমি ভোট হয়নি বললেও আমি কিন্তু সংসদ সদস্য থাকবই; সেই ক্ষমতা বলে কথা যে!

আমার ভোটের প্রথম অভিজ্ঞতা ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচন দিয়ে। সে কী দারুণ সময়! বঙ্গবন্ধুর নৌকায় আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে হবে। ছয় দফার বাস্তবায়ন করতে হলে যে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। সে কী প্রচার, প্রতিদিন ভোটের মিছিল। সেই গ্রামেই হারিকেন নিয়ে ৮-১০ মাইলের মিছিল। আমাদের গ্রাম থেকে রাজাপুর বাজার হয়ে কোনোদিন কাশিমপুর-তেমুহানি-লক্ষ্মীয়ারা বাজার হয়ে গ্রামে ফেরা, কোনোদিন এলাহিগঞ্জ-শর্শদি হয়ে ফেরা, কোনোদিন আবার রাজাপুর বাজার হয়ে সিন্দুরপুর বাজার হয়ে আসা। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর মিছিল শুরু হলে শেষ হতে হতে রাত ১২টা-১টা। জয় বাংলা স্লোগান তখন আমাদের রক্তে মিশে গিয়েছিল। মা খাবার নিয়ে বসে থাকতেন, বিরক্ত হতেন, আমাকে ‘জয় বাংলা সাহেব’ বলতেন। আমার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাঁচা হাতের উপন্যাসটার নামও দিয়েছিলাম ‘জয় বাংলা সাহেব’; কিন্তু ছাপানোর বেশ আগে শহীদ মিনারে এক গুণীজনের সম্মাননা অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে নামকরণ নিয়ে প্রসঙ্গত আলাপে তিনি বললেন যে, এত বড় একটা স্লোগান দিয়ে নামকরণ আওয়ামী লীগের অনেকে পছন্দ নাও করতে পারেন, তবে তার আপত্তি নেই। পরে নাম পাল্টে ‘মুক্তির চেতনায়’ করলাম এবং এক প্রকাশক তা বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশও করলেন। একটা কথা এখানে বলে রাখা প্রয়োজন বোধ করছি যে, জয় বাংলা স্লোগান এখন আবার ফিরে এসেছে এবং বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। নতুন প্রজন্ম আবার আমাদের সময়ে ফিরে আসছে। আমার ছোট্ট ছোট্ট পোতা-পুতিও এখন জয় বাংলা, জিতবে আবার নৌকা বলে, একজন বলে জয় বাংলা, জিতবে আমার নৌকা। ও এত ছোট যে ‘আবার’ এবং ‘আমার’ একাকার করে ফেলে। অর্থ কিন্তু দুটোতেই মূল্যবান।

যাক, যা বলছিলাম- ’৭০-এর নির্বাচনে মাইকের ব্যবহার ছিল; কিন্তু এখনকার মতো রেকর্ডে মাইক বাজত না, একজন সত্যি সত্যি মাইকে স্লোগান দিতেন। এখন দেখি, রিকশাচালক রিকশা চালাচ্ছেন, আর মাইকে স্লোগান বাজছে। কী মজা, লোক ছাড়া রেকর্ডে স্লোগান! আমরা ভোট আদায়ের জন্য কত কষ্ট করে মুরুব্বিদের বোঝাতাম। আমাদের এক দাদা তখন কিছুটা জামায়াতি ছিলেন, তিনি রহিম উল্লাহ চৌধুরীকে ভোট দেবেন। আমরা কয়েকজন মিলে তাকে নৌকার উপকারিতা বোঝাতে সচেষ্ট হলাম। গ্রামবাংলায়, বিশেষত আমাদের বাড়ির তিন পাশে নদী থাকায় তাকে নৌকা ছাড়া চলবে না বলে বলে কাবু করেছিলাম। এখন কি আর এত বোঝানোর দরকার পড়ে? এখন তো সোজা পথ- আপনার কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই, আপনার ভোট হয়ে গেছে; অথবা আগের রাতেই নাকি সিল হয়ে গেছে। আমাদের বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার তো রাতের সিল থেকে উত্তরণের জন্য ইভিএমের ‘ওকালতি’ করেছেন। এ নির্বাচন কমিশনটাকেই আমার নিকট কেমন ‘খেলনা-খেলনা’ মনে হয়। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাকি ‘বুজুর্গ’ ব্যক্তি, তিনি নাকি ‘বুজুর্গ-দল’ তরিকত ফেডারেশনের সুপারিশকৃত। সত্য-মিথ্যা আমি বলতে পারব না, তবে লোকে বলে বলেই বললাম আর কী। হবে হয়তো, তা না হলে কি আর তিনি হজ টিমে নেতৃত্ব দিতে পারতেন? প্রধান নির্বাচন কমিশনার হতে হলে সব কাজের ‘কাজী’ হতে হবে বটে, তা ছিপ দিয়ে মাছ ধরাই হোক কিংবা হজে নেতৃত্ব দেয়াই হোক। ইভিএমের মতো একটা ‘বাজে-মেশিনের’ ওয়াজ করার মধ্যে কোনো ‘ফজিলত’ আছে বলে আমরা মনে করি না। ভোটারের লাইনের ভোট নিশ্চিত করতে পারাই হচ্ছে বড় সফলতা। গত জাতীয় নির্বাচনে এবং উপজেলা-ইউনিয়ন নির্বাচনে এ কমিশন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, যার কোনো পূর্ব নজির নেই।

আমরা অনেকে, আমি তো বটেই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পছন্দ করি না। আমি তো আমার কোনো কোনো লেখায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ‘টেট্টাবধায়ক’ বলেও উল্লেখ করেছি। অবশ্যই এটা ব্যঙ্গার্থক উচ্চারণ। যে সরকার নির্বাচনের পর পাঁচ বছর দেশ চালাবে তাদের ঠিক করার জন্য তিন-মাইস্যা একটা অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন প্রয়োজন, তা আমার বোধগম্য হয় না। এতে অবশ্য কেউ কেউ খুশি হয় এ জন্য যে, তারা ক’দিনের জন্য বিনা ভোটে উপদেষ্টা অর্থাৎ মন্ত্রী-মন্ত্রী ভাবে থাকতে পারেন এবং নিজেদের নাম উজ্জ্বল করতে সক্ষম হন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন স্বীকৃত এবং প্রশংসনীয় বটে, জনগণও তাতে স্বস্তিবোধ করে, তারা নিজেদের ভোট নিজেরা দিতে পারে (নগণ্য ব্যতিক্রম ছাড়া)। এমনকি এ ভোটে অংশগ্রহণের হারও তুলনামূলকভাবে অনেক অনেক বেশি। কিন্তু সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত হওয়া সরকার যখন অপকর্ম শুরু করে, তখন কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো প্রতিকার দিতে পারে? আমি বলি, তা যদি না পারে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন করে কী লাভ হল? অতএব নির্বাচিত সরকারই নির্বাচন করুক, অপকর্মের দায়ও তাদেরই থাকুক। রাজনীতির রসায়ন বড় অস্থিতিশীল। এটার দ্রবণ কখন যে কী হয়ে যায়, তা বাস্তব রসায়নে মিলে না। তত্ত্বাবধায়কের জন্য ঘোর আন্দোলন করে আওয়ামী লীগই আবার তত্ত্বাবধায়ককে ‘কবর’ দিল। হয়তো দলটি বুঝতে পেরেছে যে, উদ্দেশ্য সাধন হয়ে গিয়েছে। এখন আর অন্যকে উদ্দেশ্য সাধনের সুযোগ দেয়া বোকামি হবে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারলে এর চেয়ে উত্তম আর কোনো পদ্ধতি নেই। অথচ আমাদের সে আশা গুড়েবালি। ফলে আমজনতা নীরবে এবং ভয়ে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন হজম করে যাচ্ছে, করতে বাধ্য হচ্ছে।

জনগণের মধ্যে হালে নির্বাচন নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। দলীয় এবং দলকানা বা দলমনা ছাড়া সাধারণ ভোটাররা বর্তমান নির্বাচন কমিশনে আস্থাশীল বলে মনে হয় না। চলার পথে অনেকের প্রশ্ন রয়েছে- ভোট দিলেই বা কী, না দিলেই বা কী, যে হওয়ার সে তো হবেই। এটা একটা নেতিবাচক মন্তব্য অবশ্যই। এই যে সিটি নির্বাচনের হাওয়া বইছে, কিন্তু সাধারণ ভোটারদের মাঝে তো তার কোনো আমেজ দেখা যাচ্ছে না! দলকানা আর দলমনা ছাড়া বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে যা বুঝলাম, তার সায় হচ্ছে- তারা ভোট দিতে যেতে আন্তরিকভাবে কোনো তাগিদ অনুভব করছেন না। তাদের যুক্তি দুটি- এক. ইভিএম তাদের কাছে একটা বিরক্তিকর মেশিন, তাদের ভোট দেয়ার তৃপ্তি থাকবে না; দুই. গত কয়েক ভোটের অভিজ্ঞতায় (দলীয় সরকারের অধীন) তারা বুঝেছে যে ভোট না দিলেও যাকে সরকারি দল সমর্থন দেবে, সে জিতবেই। এমন মনোভাব বস্তুত ভোট-প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থাকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করে, সরকারসমর্থিত প্রার্থীর জয়ের নিরপেক্ষতাকেও কম প্রশ্নবিদ্ধ করে না। জনগণের অনেকের অর্থাৎ আমজনতার এমন মনোভাব সরকারসমর্থিত প্রকৃত জনপ্রিয় প্রার্থীকেও নেতিবাচক-ইমেজে ফেলে দেয়। এটি তার জন্য দুঃখজনকই বটে। সরকার এবং এ নির্বাচন কমিশন তাদের নির্বাচন-প্রক্রিয়া সংক্রান্ত ‘ভাবমূর্তি’ পুনরুদ্ধার করতে পারবে কি না, তার ওপরই নির্ভর করছে জনগণের আস্থাশীল হওয়া। এসব নানা কারণেই এখন অনেকের কাছে ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব, কিংবা দেখে শুনে বেছে দেব’-এর পরিবর্তে প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে ‘আমার ভোট আমি দেব?’ আমরা এ প্রশ্নের হ্যাঁসূচক জবাব প্রত্যাশা করি।

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

এই বিভাগের আরও খবর