এশিয়া কাপ ২০০৭ ও ইরাকি রূপকথা
চার দশকের মত আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে অনুপস্থিত থাকা এবং ফিরে এসে যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশকে নতুন আশা দেখানো! এটা কি রুপকথা নয়?
মধ্যপ্রাচের দেশ ইরাক, যার ছিলো এক সমৃদ্ধ অতীত। তবে বিগত শতাব্দীর শেষে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে তাকেই আমরা দেখি ভঙ্গুর রূপে। একের পর এক যুদ্ধ তাদের অস্তিত্বকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে শুরু করে। ১৯৯০ এ উপসাগরীয় যুদ্ধ এবং ২০০৩ এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে প্রাণ হারায় লক্ষ লক্ষ মানুষ।
ছাই থেকে জন্ম নেয় ফিনিক্স পাখি, আর যুদ্ধক্লান্ত ইরাকের আলো হয়ে জন্মায় তাদের ফুটবল। আজ আমরা দেখবো কিভাবে একদল ফুটবল খেলোয়াড় পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছিলো তাদের দেশকে।
ইরাক সবসময়ই এশিয়ার অন্যতম ফুটবল পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলো। ১৯৮২ তে এশিয়া কাপ জয় এবং ১৯৮৬ তে প্রথম বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ। এরপরই শুরু হয় তাদের ক্রান্তিকাল।
উদয় হোসেন, তৎকালীন ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের ছেলে ছিলেন ইরাকি ফুটবল সংস্থার প্রেসিডেন্ট। এমনও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আশানুরূপ ফল না পেলে তিনি ফুটবলারদের ওপর অত্যাচার করতেন। এর একটি উদাহরণ আব্বাস, যিনি কিনা পেনাল্টি মিস করায় জেলে ছিলেন তিন সপ্তাহ।
এভাবেই ধীরে ধীরে পড়তে থাকে ইরাকি ফুটবলের জয়গাঁথা। ১৯৯০ এ উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় তাদেরকে সকল আর্ন্তজাতিক আসর থেকে বাতিল করা হয়। ফলত ১০ বছরের বেশি সময় তারা আর্ন্তজাতিক ফুটবল থেকে বঞ্চিত হয়।
যুদ্ধক্লান্ত ইরাক ফের আমেরিকার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ২০০৩ এ। অবধারিত ধ্বংস, মৃত্যু এবং এরিমধ্যে মার্কিন সৈন্যদের হাতে মারা যান উদয় হোসেন।
ইরাকি ফুটবল দল একসময় আর্ন্তজাতিক ফুটবলে ফেরে। কিন্তু তাদের সুযোগ সুবিধা বলতে ছিলো না তেমন কিছুই। স্বজন হারানোর দুঃখ তখনো তরতাজা। ভাই হারানো গোলকিপার সারবি, চোখের সামনে পুরো পরিবারের খুন হতে দেখা মিডফিল্ডার নাশাত আকরাম, এমনকি কোয়ার্টার ফাইনালের দুই দিনে আগে মা হারানো মোল্লা মোহাম্মদকে নিয়ে মাঠে গড়ায় ইরাকি ফুটবল।
অনুশীলনের সময় আশে পাশে এয়ার স্ট্রাইকও তাদের কাছে আশ্চর্যের ছিলো না। ২০০৭ এশিয়া কাপের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও জাতীয় দলে ছিলো না কোনো কোচ। ব্রাজিলিয়ান কোচ জোরবান ভিয়েরাকে নিয়োগ দেয়া হয় টুর্নামেন্ট শুরুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে।
যুদ্ধ, জীবনের অনিশ্চয়তা এবং মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া ফুটবলারদের নিয়ে গড়া এই দল ভাবতেই পারেনি অংশগ্রহণের কথা। কিন্তু দেশের জন্য অর্জন ও আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে তাদের চর্চা ফিরিয়ে আনার সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাননি কেউই।
১৬ দলের অংশগ্রহণে এশিয়া কাপ গড়ায় থাইল্যান্ডে। যেখানে ছিলো জাপান, কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার মত টিম। ইরাক কী স্বপ্নেও জেতার কথা ভেবেছিল?
প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক থাইল্যান্ডের সাথে ড্র করে ইরাক। আর পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ৩-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করে দেয়। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ওমানের সাথে ড্র করে পরর্বতী রাউন্ডে পৌঁছে যায় তারা।
আশা অতিক্রম করে আসা ইরাকি দল স্বপ্ন দেখতে শুরু করে এবার। ২-০ গোলে হারায় ভিয়েতনামকে। সেমিফাইনালের দিকে এগিয়ে দেয় ক্যাপ্টেন মাহামুদের জোড়া গোল। সেমিতে দক্ষিণ কোরিয়া ইরাকের স্বপ্নের পথে সবচে বড় পরীক্ষা নেয়। ১২০ মিনিটের সিংহভাগ থাকে কোরিয়ানদের দখলে, ফলাফল আসে না কোনো, খেলা গড়ায় পেনাল্টিতে। শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়ে ফাইনালে পৌঁছে যায় ইরাক।
উল্লাসে মেতে ওঠে বাগদাদ। মানুষ দলে দলে রাস্তায় নেমে আসে। এত বছর পর সমর্থকরা কিছু অর্জনের আনন্দ পায়। কিন্তু সেই আনন্দের আয়ু ছিলো কয়েক মুহুর্ত মাত্র। সন্ত্রাসী আক্রমণ আর বোমা বিস্ফোরণে আনন্দ মিছিলে আসা ৩০ জনের বেশি সমর্থক প্রাণ হারান। কান্নায় ভেঙে পড়ে পুরো দল।
ম্যাচের আগে প্রেস ব্রিফিংয়ে ক্যাপ্টেন মাহামুদ বলেন, “এই ম্যাচ আমাদের জিততেই হবে। একজন মা তার চোখের সামনে সন্তানের মৃত্যু দেখেছে এই খেলার জন্য। ওই মায়ের জন্য হলেও আমাদের এই খেলা জিততে হবে।”
জিতেছিলেন মাহামুদ ও তার দল। ৭২ মিনিটে হেড দিয়ে মাহামুদের করা গোলটিই ছিলো ম্যাচের একমাত্র গোল। ফলাফল : ইরাক ১- ০ সৌদি আরব। ইরাক, এশিয়ার নতুন চ্যাম্পিয়ন।
দলীয় অর্জনের পাশাপাশি টুর্নামেন্টের প্রায় সব ব্যক্তিগত অর্জনও ছিলো ইরাকিদের। গোলরক্ষক সারবি জিতেন সেরা গোলরক্ষকের খেতাব। মাহামুদ জেতেন সব্বোর্চ গোলের অর্জন। টুর্নামেন্ট সেরা হন আকরাম।
এই ঐতিহাসিক বিজয় ছিলো যেনো এক জাদুবাস্তব জার্নি। জেলের অন্ধকার থেকে আর্ন্তজাতিক খ্যাতি, কি ছিলো না এতে! পুরো দেশ যুদ্ধ ভুলে একসাথে আনন্দে মেতে উঠেছিলো।
যুদ্ধের ক্লান্তি আর সুখের অশ্রু সবমিলে একত্র হয়েছিলো একটি দেশ। ইরাকিদের স্বর্ণ ইতিহাসে যুক্ত হয়েছিলো এক নতুন অধ্যায়।
লেখক: তন্ময় হাসান
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
এমআই/